ডেস্ক রিপোর্ট: বাজার থেকে নিশ্চিন্তে কী খাবার কিনে খাবেন? সব খাবারেই ভেজাল! দেশের বাজারে বিক্রিত খাবারের মান সম্পর্কে সাধারণ মানুষ এমনই সন্দেহ প্রকাশ করে থাকেন। তাদের এ সন্দেহ যে অমূলক নয়, তার প্রমাণ মিলেছে রাজধানীর মহাখালীর জনস্বাস্থ্যে ইনস্টিটিউটের ন্যাশনাল ফুড সেইফটি ল্যাবরেটরির (এনএফএসএল) প্রায় পাঁচশ প্রকারের খাদ্য ও খাদ্য দ্রব্যের নমুনা পরীক্ষায়!
রাজধানী ঢাকা, কুমিল্লা, রাজশাহী, ফরিদপুর, পাবনা ও যশোর এ পাঁচ শহর থেকে ঘি, সরিষা ও সয়াবিন তেল, সেমাই, লাচ্ছা সেমাই, ফুলকপি, বেগুন, শিম, কাঁচা মরিচ, টমেটো ও নুডুলসের প্রায় পাঁচশ নমুনা সংগ্রহ করে পেস্টিসাইড, রং, আফলা টক্সিনের উপস্থিতি ও মাইক্রোবায়োরজিক্যাল পরীক্ষা করা হয়। এসব খাদ্য ও খাদ্যদ্রব্যের নমুনা পরীক্ষায় হাতেগোনা দু’একটি ছাড়া প্রায় সব খাদ্য ও খাদ্যসামগ্রীতে কম-বেশি ভেজাল থাকার প্রমাণ মিলেছে।
শনিবার দুপুরে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সম্মেলন কক্ষে ‘মনিটরিং অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন অব হর্টিকালচার প্রোডাক্টস অ্যান্ড আদার ফুড কমোডিটিজ ফর কেমিক্যাল কন্টামিনেশন অ্যান্ড মাইক্রোবায়োলজিক্যাল অ্যাট এনএফএসএল: অ্যান অ্যাপ্রাইজাল অব ফুড সেফটি সার্ভে ইন বাংলাদেশ-সেকেন্ড রাউন্ড’ শীর্ষক জরিপের প্রাপ্ত ফলাফল প্রকাশ করা হয়।
জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট পরিচালক ডা. মো. আনিছুর রহমানের সভাপতিত্বে ল্যাবরেটরির প্রধান প্রফেসর ডা. শাহনীলা ফেরদৌসী জরিপ ফলাফল উপস্থাপন করেন। এ সময় বিশ্ব খাদ্য সংস্থার (এফএও) সিনিয়র ন্যাশনাল অ্যাডভাইজর প্রফেসর শাহমনির হোসেন, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) সভাপতি অধ্যাপক ডা. এম ইকবাল আর্সলান, খাদ্য নিরাপত্তা অধিদফতরের চেয়ারম্যান মাহফুজুল হক, বাংলাদেশ ব্রেস্ট ফিডিং ফাউন্ডেশন (বিবিএফ) চেয়ারপারসন ড. এস কে রয় বিশেষ অতিথি ছিলেন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব অর্থায়নে ২০১৫-১৬ মেয়াদে প্রথম সার্ভে কার্যক্রম শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৬-১৭ সালে নুডুলস, ঘি, সরিষা ও সয়াবিন তেল, সেমাই, লাচ্ছা সেমাই, ফুলকপি, বেগুন, শিম, কাঁচা মরিচ, টমেটোসহ সর্বমোট ৪৬৫টি নমুনা পেস্টিসাইড, রং, আফলা টক্সিনের উপস্থিতি মাইক্রোবায়োরজিক্যাল পরীক্ষা করা হয়।
নমুনাসমূহ ফুড গ্রেড ব্যাগে সংগ্রহ এবং নির্ধারিত নিয়মানুযায়ী এনএফএসএলে প্রেরণ, সংরক্ষণ এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে নির্ধারিত পরীক্ষা পদ্ধতি যা এনএফএসএলে ভেলিডেটেড এবং পাবলিশড পরীক্ষা পদ্ধতিতে করা হয়। মাইক্রোবায়েলজিক্যাল পরীক্ষার জন্য নির্দিষ্ট ব্যাগে, নির্দিষ্ট নিয়মে নমুনা সংগ্রহ, পরিবহন, সংরক্ষণ এবং পরীক্ষা করা হয়।
ফলাফল: নমুনা : ঘি, সরিষা ও সয়াবিন: ৩৮টি ঘি পরীক্ষায় ২৭টিতে বিআর ও সাবানিমান, ১৭টিতে মুক্ত এসিডমান এবং ২০টিতে আর্দ্রতার মানের তারতম্য পাওয়া যায়। ৩১টি সরিষা তেল পরীক্ষায় ১৮টিতে সাবানিমান, ২৭টিতে মুক্ত এসিডের মান, ১২টিতে আয়োডিনের মান এবং ৮টিতে আয়রনের মানের তারতম্য পাওয়া যায়। ২৭টি সয়াবিন তেলের মধ্যে ১৭টিতে বিআর ১৩টিতে সাবানিমান এবং ১২টিতে আয়োডিনের মানের তারতম্য পাওয়া যায়।
টমেটো: মোট ৩০টি টমেটো নমুনার মধ্যে জেলা পর্যায়ের বাজার থেকে সংগৃহীত ২টিতে ক্লোরোপাইরিফস পেস্টিসাইড পাওয়া যায়। এর গ্রহণযোগ্য মাত্রা (ইইউ) ১০ পিপিবি (প্রতি কেজিতে ১ মাইক্রোগ্রাম)। সেখানে ২টি নমুনাতে ২০ এবং ২২ মাত্রায় উপস্থিতি পাওয়া যায়।
বেগুন: মোট ৩০টি বেগুনের নমুনার মধ্যে ঢাকার বাজারের একটিতে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণে ডাইমেথয়েট পেস্টিসাইড পাওয়া যায়।
ফুলকপি: মোট ৩০টি ফুলকপি নমুনার মধ্যে জেলা পর্যায়ের ৭টি এবং ঢাকার বাজারের ৫টি মোট ১২টিতে ক্লোরোপাইরিফস পেস্টিসাইড পাওয়া যায়। তারমধ্যে জেলা পর্যায়ের ২টি নমুনায় গ্রহণযোগ্য মাত্রা (ইইউ) ৫০ পিপিবির বেশি পাওয়া গেছে। একটিতে ৬৭ পিপিবি অন্যটিতে ৬৬ পিপিবি মাত্রা। অন্যগুলোতে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে কম মাত্রায় পাওয়া যায়।
শিম: মোট ৩০টি শিমের নমুনার মধ্যে ১১টি জেলা পর্যায়ের, ৪টি ঢাকা শহরের বাজারের নমুনা মোট ১৫টিতে ক্লোরোপাইরিফস পেস্টিসাইড পাওয়া যায়। গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৫০ পিপিবির বেশি পাওয়া যায় ১টি নমুনায় (৫৩ পিপিবি)। বাকিগুলোতে গ্রহণযোগ্য মাত্রার মধ্যে পাওয়া যায়।
কাঁচা মরিচ: মোট ৩০টি কাঁচা মরিচের নমুনার মধ্যে ৮টি জেলা পর্যায়ের, ৭টি ঢাকার বাজারের নমুনায় মোট ১৫টিতে ক্লোরোপাইরিফস পেস্টিসাইড পাওয়া যায়। গ্রহণযোগ্য মাত্রা ১০ পিপিবির বেশি পাওয়া যায় সব ক’টি নমুনায় (১২-১১৯ পিপিবি)।
পেস্টিসাইডের মাত্রা কমানোর জন্য ধৌতকরণ প্রক্রিয়া: মোট ১৫০টি বিভিন্ন সবজি নমুনা পরীক্ষা করে ৪৫টিতে বিভিন্ন রকমের পেস্টিসাইডের উপস্থিতি পাওয়া যায়। পানিতে পাঁচ মিনিট করে ধৌত করার মাধ্যমে প্রথমবার এবং দ্বিতীয়বার ধৌত করার পর পেস্টিসাইডের উপস্থিতি পরীক্ষা করা হয়।
প্রথমবার ধৌতকরার পর ২৯টি নমুনায় কোনো পেস্টিসাইডের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয় ধৌতকরার পর ১০টিতে কোনো পেস্টিসাইড পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয়বার ধোয়ার পরও ৬টি নমুনার পেস্টিসাইডের উপস্থিতি থেকে যায়।
নুডুলস: ঢাকা শহরের বিভিন্ন বাজার ও সুপার শপ থেকে সংগৃহীত বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ৫৫টি নুডুলস নমুনার গুণগত মান পরীক্ষা করা হয়। যার মধ্যে ১৩টিতে নির্দিষ্ট মাত্রার চেয়ে প্রোটিনের পরিমাণ কম পাওয়া যায়। লেডের পরিমাণ নির্দিষ্ট মাত্রার চেয়ে অনেক কম ও অনেকগুলোতে শূন্যে মাত্রায় পাওয়া যায়।
সেমাই: অনুরূপভাবে ১৫টি সাধারণ ও ১৫টি লাচ্ছা সেমাই পরীক্ষা করা হয়েছে। ১টি সাধারণ সেমাইয়ে, ১০টি লাচ্ছা সেমাইয়ের মাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণে আর্দ্রতা পাওয়া যায়। ৩টি সাধারণ সেমাই, ১০টি লাচ্ছা সেমাইয়ে মাত্রার চেয়ে কম প্রোটিন পাওয়া যায়।
মাইক্রোবায়োলজিক্যাল পরীক্ষায় ১টি সাধারণ সেমাইয়ে, ৮টি লাচ্ছা সেমাইয়ে ঈস্ট, মোল্ডের উপস্থিতি পাওয়া যায়।
ঝালমুড়ি-ভেলপুরিতে টাইফয়েডের জীবাণু: এছাড়া একই প্রতিবেদনে রাজধানী ঢাকার প্রায় প্রতিটি স্কুল বা বিভিন্ন সড়কের সামনে প্রতিদিন ঝালমুড়ি, ভেলপুরি, আচারসহ নানা খাদ্যসামগ্রীর নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এসব নমুনা পরীক্ষায় টাইফয়েডবাহী সালমোনিলা রোগের জীবাণু পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজধানীর বিভিন্ন থানার ৪৬টি স্কুলের সামনে থেকে ৪৬টি ঝালমুড়ি, ৩০টি ফুসকা, ১৬টি ভেলপুরি ও ৪২টি আচারের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। সংগৃহীত এসব নমুনাতে মাইক্রোটক্সিন, কৃত্রিম রঙের উপস্থিতি ও মাইক্রোবায়োলজিক্যাল, ঈস্ট-মোল্ড, কলিফর্ম, সালমোনিলা, ই-কলাইয়ের উপস্থিতি নির্ণয়ের জন্য পরীক্ষা করা হয়।
পরীক্ষায় দেখা গেছে, ১৬টি ভেলপুরি নমুনার সবগুলোতেই ঈস্ট-মোল্ড ও কলিফর্মের পরিমাণ স্বাভাবিকমাত্রার চেয়ে বেশি পাওয়া যায়।