আন্তর্জাতিক ডেস্ক: সৌদি আরবের শীর্ষ সামরিক পদগুলোর রদবদলকে আন্তর্জাতিকভাবে নতুন লক্ষ্য অর্জনের কৌশল হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। তারা মনে করছেন, এই রদবদল বাদশাহ-পুত্র মোহাম্মদ বিন সালমানের পশ্চিমা উদারবাদী সংস্কারে ধাবিত হওয়ার প্রচেষ্টারই অংশবিশেষ। স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পদে পছন্দের মানুষ নিয়োগ দেওয়াকে কেউ কেউ আবার কেবল যুবরাজের ক্ষমতা সুসংহত করার প্রচেষ্টা হিসেবেই দেখছেন। সোমবার দিবাগত মধ্যরাতে রাজকীয় ফরমান বলে কয়েকজনকে বরখাস্ত করা হয়। অনেককে পদোন্নতি দেওয়ার পাশাপাশি শূন্যপদেও জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়।
বর্তমান বাদশাহর ছেলে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি মনে করা হয়। দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও তার হাতে। তিনি ‘ভিশন ২০৩০’ নামে এক সংস্কার পরিকল্পনায় রাজতন্ত্রের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের বিষয়টি সামনে আনেন। আর অর্থনৈতিক সংস্কারের সঙ্গেই সামনে আসে সামাজিক পুনর্গঠনের প্রশ্ন। এরই ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে পরিবর্তন আনছেন তিনি।
সোমবার আরব সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, সেনাপ্রধান জেনারেল আব্দুর রহমান আল-বুনিয়ানকে রাজকীয় দরবারের উপদেষ্টা করা হয়েছে। এছাড়া জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তার সহকারী লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফায়াদ আল-রুওয়ালিকে। রদবদলে অর্থনীতি ও নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন সহকারী মন্ত্রীকে বরখাস্ত করে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে নতুন লোককে। এছাড়া আল জাউফ শহরের মেয়র পদ থেকে প্রিন্স ফাহাদ বিন বদরকে সরিয়ে প্রিন্স বদর বিন সুলতানকে নিয়োগ দিয়ে ফাহাদ বিন বদরকে বাদশাহর উপদেষ্টা ও মন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রিন্স তুর্কি বিন তালালকে আসির শহরের নতুন মেয়র ঘোষণা করা ছাড়াও হাইল শহরের সহকারী গভর্নর করা হয়েছে প্রিন্স ফয়সাল বিন ফাহাদ বিন মুকরিনকে। দেশটির সরকারি সংবাদমাধ্যমে শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের বরখাস্তের রাজকীয় ফরমানের কথা বলা হলেও তাদের সরিয়ে দেওয়ার কারণ সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি।
মোহাম্মদ বিন সালমান যুবরাজ এর আগে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে একাধিক মন্ত্রীকে আটক করেন। ২০১৭ সালের ৪ নভেম্বর থেকে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের নামে যুবরাজের নির্দেশে রাজপরিবারের অনেক সদস্যকে আটক করা হয়। এর মধ্যে রাজপরিবারের নারী সদস্যও ছিলেন। পরে অবশ্য মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে তাদের অনেককে ছেড়ে দেওয়া হয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রকৃতপক্ষে নিজের ক্ষমতা সংহত করার পথে যাদেরই হুমকি মনে করছেন, তাদের ওপরই ধরপাকড় চালাচ্ছেন যুবরাজ। তবে যুবরাজ বরাবরই এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে প্রথা ভেঙে বিভিন্ন বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নেওয়ার মাধ্যমে ‘অনেক শত্রু’ তৈরি করে ফেলেছেন সৌদি যুবরাজ। সে কারণে সামরিক বাহিনীর ওপর নিজের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্যও এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সিঙ্গাপুরের এস রাজা রত্নম স্কুল অব ইন্টারন্যাশনার স্টাডিজের সিনিয়র গবেষক জেমস ডোরসেই বলেন, সৌদি যুবরাজই দেশ চালাচ্ছেন এতে কোনও সন্দেহ নেই। অবশ্যই মনে রাখতে হবে, যুবরাজ সৌদি আরব সরকারের কাঠামো পরিবর্তন করেছেন। আগে ঐক্যবদ্ধভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও এখন সেখানে একজনের শাসন চলছে।
জেমস ডোরসেই আরও বলেন, সামরিক ও বেসামরিক উভয়ক্ষেত্রেই সামনের দিনে আরও পরিবর্তন দেখতে পাবো। কারণ যুবরাজ সবখানে নিজের লোক নিয়োগ দেওয়ার মাধ্যমে সৌদি আরবের একটি ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরির চেষ্টা করছেন। তবে ইয়েমেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট সমস্যার কারণেই এই পরিবর্তন কিনা, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। আর সৌদি নাগরিকরা ও সামরিক বাহিনীও এসব সিদ্ধান্তের কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে তাও বলা যাচ্ছে না।
শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের পদে রদবদলের আগে সম্প্রতি পাকিস্তান থেকে আরও এক হাজার সেনা পাঠানোর খবর প্রকাশিত হয়। সে সময় ‘ব্রুকিংস ইন্টেলিজেন্স প্রজেক্টের’ পরিচালক ও সিআইয়ের সাবেক বিশ্লেষক ব্রুস রিডেল বলেন, সৌদির যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান তিন বছরে অনেক শত্রু তৈরি করে ফেলেছেন, যাদের অনেকে রাজপরিবারের সদস্য। যুবরাজের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কাজ করতেই পাকিস্তানি সেনাদের মোতায়েন করা হয়ে থাকতে পারে। এতে শত্রুরা যদি শেষ পর্যন্ত তাকে হত্যা বা উৎখাত করতে চলেও আসে, তাহলেও ওই বাহিনী তার ও পাকিস্তানের প্রতি অনুগত থাকতে বাধ্য হবে। তার বক্তব্যে বোঝায় যায়, দেশটির সামরিক বাহিনীর মধ্যেই যুবরাজের অনেক শত্রু রয়েছে। তাই তাদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তিনি এসব উদ্যোগ নিয়ে থাকতে পারেন।
তবে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, সৌদি আরবে তার সামাজিক সংস্কার কার্যক্রমকে আরও জোরদার করতেই যুবরাজ এমন উদ্যোগ নিয়েছেন। ইতোমধ্যে তিনি নারীদের গাড়ি চালানো ও স্টেডিয়ামে বসে খেলা দেখার অনুমতি দিয়েছেন। আর প্রায় তিন দশক বন্ধ থাকার পর সিনেমা হলগুলোর খোলার অনুমতিও দিয়েছেন তিনি। তার এসব সংস্কারে দেশের তরুণরা ব্যাপক সমর্থন জানিয়েছে। আর এই তরুণ সমাজই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা। তাই তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার জন্যই তরুণদের দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিচ্ছেন।
রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের দেওয়া সাক্ষাৎকারে সৌদি বিশ্লেষক আহমেদ আল-তাওয়ান বলেন, নতুন নিয়োগের মাধ্যমে স্থানীয় সরকারের মধ্যে ‘তরুণ রক্ত ঢোকানো’ হচ্ছে। একই সঙ্গে শীর্ষ সামরিক পদগুলোতেও তরুণ কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়। সূত্র : বিবিসি, আল জাজিরা, রয়টার্স।

সৌদি বাদশাহ সালমান ও যুবরাজ মোহাম্মদ বিল সালমান