আমরা ছোটবেলা ছোট ক্লাসে পড়েছি পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতা হলো মিশর, হরাপ্পা-মহেঞ্জোদারো (সিন্ধু), ভারত ও চৈনিক সভ্যতার কথা। ওসব সভ্যতার ভুরি ভুরি ঐতিহাসিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। ভাষার ব্যবহার, লেখার প্রচলন, পাথরের হাতিয়ার ইত্যাদি পাওয়া গেছে। ওগুলো থেকে সভ্যতার প্রামাণিক উপকরণ সংগ্রহ করে পরিক্ষা নিরীক্ষা করা হয়েছে। ওসব সভ্যতা সাত হাজার বছর আগের বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু পাথরের প্রাগৈতিহাসিক যুগের তথ্য নিয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে দ্বি-মত দেখা যায়। ইদানিং বাংলাদেশে মানুষের বসতি স্থাপনে পাথর যুগের প্রাগৈতিহাসিক অনেক তথ্য গবেষণায় বেরিয়ে আসতেছে। তা’ছাড়া বাংলাদেশের নৃ-তাত্তি¡ক গবেষণায় লাখ লাখ বছর আগে সভ্যতার ধারণা করা হচ্ছে এবং গবেষণাও চলছে। প্রাচীন বলতে লাখ লাখ বছরের মধ্যে কতো লাখ বছরকে ধরা হতে পারে? এটা কি দশ, বিশ, পঞ্চাশ একশো বা তারও বেশি কি-না? ধারণার সীমারেখা হলো দশলাখ বছর আগে চিনামাটির পাহাড় এলাকা। কিন্তু অনেকে মনে করেন পঞ্চাশ বা তদুর্ধ্ব লাখ বছর আগেই এসব ছিলো। এতো প্রাচীন হলে এগুলোর কোনো তথ্য এতোদিন জানা যায়নি কেনো? উত্তরে বলা যায় গবেষণার অভাব। তার চেয়েও বেশি অভাব প্রচার করার প্রতিকূল অবস্থা। ওগুলো প্রচার করার মতো কোনো প্রযুক্তি মাধ্যম বা প্রচার মাধ্যম নিয়ে আমরা ভাবতে শিখিনি। তাই অন্যান্য সভ্যতার চেয়ে লাখ লাখ বছর পুরোনো, কম করে হলেও দশ লাখ বছরের পুরোনো সভ্যতার কথা আমরা জানি না। আমাদের সুপ্রাচীন ইতিহাস প্রচার হীনতায় চরম রুগ্ন বলে অনেকে মনে করেন। লাখ লাখ বছর আর কোটি বছরের মধ্যে বেশ পার্থক্য। এক লাখ থেকে নিরান্নব্বই প্লাস হলো কোটি সংখ্যা। চিনামাটির পাহাড়ে মানুষ বসবাসের বিষয়টিকে কেউ কেউ তিরিশ বা চল্লিশ লাখ বছরের প্রাচীন বলেও ধারণা করেন। ঐতিহাসিক সভ্যতার সময় হলো মাত্র সাত/আট হাজার বছরের প্রাচীন। ঐতিহাসিক সভ্যতাকে সময়ের গণনায় আতুর ঘরের ইতিহাস বলা চলে। বাংলাদেশের প্রচীনত্বের কাছে পৃথিবীর অন্যান্য প্রাচীনত্ব নতুনের নবপ্রসব বললে অত্যুক্তি বলা হবে না। এতো ঐশ্বর্যশালী দেশ ও জাতিকে দমিয়ে রাখার জন্যই হয়তো আমাদের পুরাকীর্তি সুদূর লাখ লাখ বছরের প্রাচীন জনপদ, সভ্যতার বিকাশ ইত্যাদি আড়ালে রাখার চেষ্টা করে চলেছে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য প্রচারবিদদের প্রচার মাধ্যম। এ দেশের মানুষ বিশেষ করে ওই আরাপাড়ার মানুষ এখনো আক্ষরিক অর্থে শিক্ষিত নয়। তবে লাখ লাখ বছরের আভিজাত্য তাদের চেহারা, আচরণ, চলাফেরা, সততায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এসব নিয়ে নি:সন্দেহে বলা যায় ওই জায়গায় আদি মানুষ বাস করতো। ওখানে আদি সভ্যতার চিহ্ন রয়েছে। মাটি খনন করলে বা কর্তৃপক্ষ সঠিক পদক্ষেপ নিলে আমাদের জাতিয় জীবনে ঐতিহ্য ও প্রাচীন সভ্যতার ‘সংবাদ বিস্ফোরণ’ ঘটতে পারে। হয়তো সারা পৃথিবীর মানুষ শেকড়ের সন্ধান পেয়ে ছুটে আসবে ওই জায়গাটিকে একনজর দেখার জন্য। তখন হয়তো প্রচলিত ধারণার প্রাচীন স্থানগুলো তাদেরও সভ্যতার পূর্বপুরুষদের দেখে স্বস্তি পাবে। গবেষণা ও প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে মানুষের সভ্যতার প্রাচীনত্ব আবিস্কারের বা উদ্ভাবনের উন্নতিও মুহুর্মুহু ঘটে চলেছে। আরাপাড়া চিনা মাটির পাহাড়ে যে স্তম্ভটি দেখছি তার ছবিও তুলেছি। আমি প্রথমে মনে করেছিলাম ওই স্তম্ভটি হয়তো তখনকার প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভিন্ন ভিন্ন মালামাল দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছিলো। কিন্তু গভীর দৃষ্টি দিয়ে দেখলাম ওই স্তম্ভের গঠন আর চিনা মাটির পাহাড়ের পাথর একই। এ চিন্তা হঠাৎ মনে হলো এ জন্য যে ওই স্তম্ভ বহনযোগ্য নয়। ওটার খন্ডিত অংশ দেখে বোঝা যায় ওই পাথর লোহার নয় বা কোনো নির্মাণ করা স্তম্ভ নয়। ওটা একেবারে ওই পাথরের অচ্ছেদ্য অংশ। পাহাড় কেটে কেটে এমন মসৃণ করেছিলো যা কল্পণাকেও হার মানায়। ভাঙ্গা অংশ না দেখলে আমার মনের জটলা আরো বেড়ে যেতো। ভাঙ্গা অংশে তাকালে সহজেই চোখে পড়ে চিনা মাটির কথিত পাহাড়েই কারুকাজ খচিত ওই অতিপ্রাচীন স্তম্ভটি ওই পাহাড়ের অংশ। শুধু কেটে কেটে তখনকার বিশেষজ্ঞগণ ওটাকে প্রাসাদে ব্যবহার উপযোগি করেছিলো। তখনকার কারিগরের অনেক নির্মাণ শৈলী এখনো অজানাই রয়ে গেছে। স্তম্ভটির গায়ে প্রলেপযুক্ত লেখা রয়েছে। মূল স্তম্ভের উপর খোদাই লেখা নয়। ওই প্রলেপ আলাদা। প্রলেপের অনেক অক্ষর খসে পড়েছে। লেখাগুলো লম্বালম্বি না চিনা-জাপানি ভাষার মতো উপর থেকে নিচের দিকে লেখা ছিলো তা-ও সহজে বোঝা যায় না। লেখাগুলো ডানে বামে যেকোনো দিক হতে শুরু করা হয়েছিলো তা অনুমান করা যায়। আমরা রোমান হরফ, গ্রীক বর্ণ বা সিন্ধু সভতার পাহাড়ের গায়ে খোদাই লেখার বর্ণ দেখেছি পুস্তকে। মিশরীয় বা ভারতীয় বর্ণেরও সংকেত বা বর্ণ লেখার নক্সাগুলো বই পুস্তকে দেখেছি। ওসব লেখার মর্মোদ্ধার এখনো অনেকাংশে অসম্ভবের পাল্লাকে ভারী করে রেখেছে। চিনা মাটির পাহাড়ে পড়ে থাকা পাথরটির গায়ে যে লেখা তা লেখা কি-না তা-ও বুঝি না। যে ভাবে ওখানে প্রলেপের উপর লেখার যে অংশটুকু রয়েছে সেটুকুর ছবি তুলে এনেছি। ওসব নিয়ে পরবর্তী নিবন্ধে আলোচনার আশা করছি। (ক্রমশ)।
লেখকঃ প্রধান শিক্ষক, শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়, টঙ্গি, গাজীপুর।
মোবাইলঃ ০১৮৫৬-৪৭০০৫০
ইমেইল-sshs.tongi@yahoo.com