চিনা মাটির পাহাড়ে সভ্যতার চিহ্নঃ চিনা মাটির পাহাড়ের কথা লিখেছি। সেখানে প্রাচীন ভাষা কী তার চিহ্ন পাওয়া যায়। মানুষ যেখানে বসবাসের আস্তানা গড়ে তোলে সেখান থেকেই ভাষা শুরু হয়। দেহের ভাবভঙ্গি থেকে শুরু করে বিভিন্ন সাংকেতিক চিহ্ন দিয়ে শুরু হয় ভাব বিনিময়। তারপর একসময় শুরু হয় কথার ফুলঝুড়ি। এভাবেই ভাষা সৃষ্টি নিয়ে ধারণা করা হয়। মুখের কথাগুলো অনেক সময় বিস্মৃত হয়ে বাতাসে মিলিয়ে যায়। কথাগুলো ধরে রাখার জন্য শুরু হয় প্রাণপণ চেষ্টা। কখনো গাছের ছালে, কখনো পাহাড়ের গুহায়, কখনো পাথর কেটে তৈরি ঘরবাড়ির দেয়ালে বা স্তম্ভে এসব সাংকেতিক চিহ্ন আঁকা হতো। এর দীর্ঘ ইতিহাস আছে। কাগজ আবিস্কারের আগে গাছের পাতায় লেখার বহু নিদর্শন আমরা দেখতে পাই। তার আগে পাথরে বা গুহার ভেতর অংকন দেখা যায়। মানুষের অস্তিত্ব ও ভাষার অস্তিত্ব প্রায় কাছাকাছি সময়ের ঘটনা। ভূতাত্তি¡কদের ধারণা বাংলাদেশের সোমেশ্বরি নদীর পশ্চিম পাড়ে মানুষ বাস করতো দশ লাখ বছর পূর্ব হতে। গারো পাহাড়ে আরো আগে। চিটাগাং গারো পাহাড়ের পাদদেশে এককোটি বছর আগে মানুষ বাসের লক্ষণ পাওয়া যায়। চিনা মাটির পাহাড় এবং রাঙ্গামাটির গারো পাহাড় দুটোই বাংলাদেশে অবস্থিত। আপাতত: চিনা মাটির পাহাড় নিয়েই কথা বলছি। সেটিই বলা দরকার। আমরা যদি ধরে নেই চিনা মাটির পাহাড়ে দশ লাখ বছর আগে মানুষ থাকতো তাহলে একটু ভাবনায় পড়ে যেতে হয়। এতো আগে মানুষ ওখানে কীভাবে বাস করতো? ওই মানুষগুলো কী-ই বা খেতো? জীবনের জন্য পানি অত্যাবশ্যক। ওই পানি ওখানে ছিল কী-না? মানুষ বসবাস করার উপযুক্ত পরিবেশ ওখানে সেই অতি প্রাচীন কালে ছিলো কী-না? আরো অনেক প্রশ্ন। এসবের উত্তর পাওয়া কঠিন নয়। যেখানে উঁচু স্থান থাকে এবং যে স্থানে গাছপালায় ফল হয় আর নীচে পানি থাকে সেসব অঞ্চলে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণি বাস করার যথেষ্ট অনুকূল পরিবেশ থাকে বলে স্বীকার করা হয়। আমরা জানি কোটি কোটি বছর আগে কীভাবে পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে। তার ধর্মীয় ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। তারপর পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব কীভাবে হলো। আরো জানা যায় মানুষের সৃষ্টিতত্ত¡। সবমিলিয়ে সভ্যতার ক্রমবিকাশ ও ক্রমধারা সম্পর্কে আমাদের ধারণা আছে। নিদর্শন দেখে দেখে সভ্যতার বয়স মাপা এখন মানুষের নিকট খুবই সহজ একটি পদ্ধতি। তা ছাড়া আমরা জানি পুরো বাংলাদেশ একসময় জলমগ্ন ছিলো। তারপর কোটি কোটি বছর পেরিয়ে প্রাকৃতিক বিবর্তনের দ্বারা বাংলাদেশে যে কটি অঞ্চল জেগে উঠেছিলো পানির নীচ থেকে তার মধ্যে এসব পাহাড় অন্যতম। মানুষ অতি প্রাচীনকালে ফলমুল, পশুর মাংস খেয়ে পেট পুরোতো আর ওই পাহাড়ের তলদেশের পানি পান করে পিপাসা মেটাতো। সে জন্য ওই পাহাড়ের গুহায় মানুষ বাস করা, কথা বলা, ভাষা সৃষ্টি হওয়া ও সভ্যতা গড়ে তোলা অতি স্বাভাবিক। যদি অমনটি না হয় তা-হলে সেটা-ই অস্বাভাবিক। প্রতœতত্ত¡বিদগণ মানুষের আবাসস্থলের যে সব তথ্য উদঘাটন করেছেন এ অঞ্চলটি ওই অঞ্চলের মতো অভিন্নরূপে মানুষ বসবাসের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চিনা মাটির পাহাড়ের নীচে এখন সমতল জমিনে ধান ক্ষেত। প্রচুর ফলন হয়। ওসব জমিতে দুটো মৌসুমে ধান চাষ করে আর শীতকালে স্বল্পমেয়াদী রবিশষ্য চাষ করে ওখানকার মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে। পানি ওসব জমিতে এখনও জমে। সারা বছর পানিতে ডুবে থাকে না। বৃষ্টির পানিতেই ফসল ফলে। শুষ্ক মৌসুমে সেচ ব্যবস্থায় ফসল ফলানো হয় । জমিগুলো অনাবাদী থাকে না। জামির হাহাকার শোনা যায় না। জমির খাদ্য যে ফসল তা জমিকে ভরিয়ে রাখে। ওসব জমি নিজেও খায় আবার মানুষকেও খাওয়ায়। এমন নির্জলা নির্ভেজাল জমি আর কোথাও আছে? চিনা মাটির পাহাড়ের পশ্চিমে অর্থাৎ পূর্ব হতে শুরু হয়ে পশ্চিম প্রান্তের শেষাংশে হঠাৎ দেখতে পেলাম একটি পাথরের লম্বা স্তম্ভ মাটিতে শুয়ে আছে। আমার সহকর্মী মোঃ হেলাল উদ্দিন মোল্লা, মোঃ মোতাহার হোসেন খান ও মাহফুজুল হক ঐ ঘুমন্ত পিলারটি আমাকে দেখালেন। আমি আশ্চর্য হয়ে দুপুরের খোলা আকাশের নিচে একঘন্টা দাঁড়িয়ে পাথরের রহস্য উদঘাটনের বৃথা আকাঙ্খায় সময় ব্যয় করলাম। বৃথা সময় নষ্ট করার ক্ষেত্রে আমি বেশ পটু। বৃথা বাক্য ব্যয়ে আনন্দ পাই। খেয়ালী মনের এ প্রভাব হতে কখনো মুক্ত হতে পারিনি। কিন্তু আজকের ঘন্টাখানেক দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করাটা আমাকে অন্য জগতের স্বাদ দিয়েছিলো। ওই শুয়ে থাকা পিলার বা স্তম্ভটি শুন্য হাতে শুধু চোখ দিয়ে গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি, হাতে ধরেছি। পাথরের দু’তিনটে টুকরো ব্যাগে পুরেছি, ছবি তুলেছি আকাশ-পাতাল চিন্তা করেছি। আজকে কোনো ক্লান্তি বোধ করিনি।
ইতোমধ্যে ওখানে আমার আরেক সহকর্মী (সাবেক ছাত্র) নুরুজ্জামান রানা এসে ওই স্তম্ভ দেখে সাথে সাথে মন্তব্য করলেন এটা প্রাচীন সভ্যতার ভগ্নাংশ। তখন চিন্তায় এলো নতুন আলোড়ন। এটা কতো প্রাচীন সভ্যতা হতে পারে। মনকে বোঝালাম স্তম্ভের আর পাথরের ভগ্নাংশের কিছু টুকরো সাথে নিয়েছি ঢাকা গিয়ে এর সমাধান খুঁজে বের কারবো এটা কতো প্রাচীন। ঢাকা ফিরে আসতে মন চাচ্ছিলো না। কর্মের পিছুটান পেটের তাগিদে ওখানে চারদিন কাটিয়ে সাথীদের কথা চিন্তা করে ফিরে আসতে হলো। ওই পাহাড় স্তম্ভ দেখার পরে ওই বিষয়টা চিন্তা রাজ্যে স্বৈরাচারের মতো পাকাপোক্ত হয়ে গেলো। বিষয়টা নিয়ে প্রথমে কথা বললাম দৈনিক আজকের প্রভাতের সম্পাদক আমার প্রিয় মানুষ জনাব ফাইজুস সালেহীন ভাইয়ের সাথে। তিনি বললেন বিষয়টা লিখুন। তারপর বললেন,“লেলিন ভাই এ ব্যাপারে গবেষক। বিষয়টা তার সথে বললে একটা সুরাহা পাওয়া যাবে।” আমি আশ্বস্ত হলেও থেমে যাইনি। আমি কথা বললাম আমার আরেক প্রিয় মানুষ চিটাগাং সরকারী কলেজের ভূগোল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর শহিদুল্লাহ মাঝির সাথে। তিনি বললেন, “আমি ওখানে দু’বার গিয়েছি। ওখানে দশ লাখ বছর আগে সভ্যতা ছিলো বলে গবেষকরা ধারণা করেছেন।” তিনি আমাকে আরো কিছু তথ্য দিলেন। আমি ওসব নিয়ে নতুন ভাবনায় জড়িয়ে গেলাম। ঘাটতে শুরু করলাম ইন্টারনেট। ভাষা ও সভ্যতা নিয়ে চিন্তার জগতে নতুন রশি খেলার গিট পাকানোতে নতুন মোড় নিলো। লেলিন ভাইয়ের মন্তব্য পাবার আশায় অপেক্ষার পালা। (ক্রমশ)।
লেখক: প্রধান শিক্ষক, শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয় টঙ্গি, গাজীপুর।
মোবাইলঃ ০১৮৫৬-৪৭০০৫০
ইমেইল-sshs.tongi@yahoo.com