আনিস আলমগীর: ইসলামের দুই হেরেমের অবস্থান সৌদি আরবে। ইসলাম মূলত দুই ফেরকায় বিভক্ত–শিয়া ও সুন্নি। উভয় ফেরকার কাছে দুই হেরেমই পবিত্র। উভয় ফেরকার অনুসারীরা হজ মৌসুমে হজ সমাপনের জন্য মক্কা-মদিনায় যায়। কালেমা, নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত- এর ব্যাপারে দুই ফেরকার মাঝে কোনও মতপার্থক্য নেই। সুন্নিরা হানাফি, মালেকি, সায়েফি ও হাম্বলি ফেকার অনুসারী। শিয়ারা জাফরি ফেকার অনুসারী।
হজরত ইমাম জাফর সাদেক (রা.) রাসূল (সা.)-এর বংশধর অর্থাৎ আহলে বায়াত। জাফরি ফেকার থেকে বহু মাসালা সুন্নি ফেকার ইমামরা তাদের ফেকায় গ্রহণ করেছেন এবং সুন্নি ফেকার চার ইমামই হজরত ইমাম জাফর ছাদেক (রা.) রাসুল্লাহ্ (স.)-এর আওলাদ হওয়ায় গভীরভাবে শ্রদ্ধা করতেন।
হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর পর ইমাম মতবাদের অনুসারী শিয়া মজহাব-এর উদ্ভাবনকাল থেকে শিয়া-সুন্নি উভয়ে হজ সমাপন করে আসছে। সম্প্রতি সৌদি আরবে বাদশা ঘোষণা দিয়েছেন শিয়ারা মুসলমান নয়। হেরেমদ্বয়ে অমুসলমান প্রবেশ নিষেধ। তাহলে তো আগামী বছর থেকে শিয়াদের হজ করা আর সম্ভব হবে না! কারণ শিয়ারা মুসলমান নন—এ ফতোয়া যারা দিলেন তারাই সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়।
মুসলিম বিশ্ব কি সৌদি বাদশার এ ফতোয়া মেনে নেবে? মুসলিম বিশ্বের প্রত্যেকটি দেশে শিয়া-সুন্নি উভয় ফেরকায় বিশ্বাসী মুসলমান রয়েছে। বাংলাদেশের বিশিষ্ট বুজুর্গ হজরত মরহুম মুহাম্মদুল্ল্যাহ হাফেজ্জি হুজুর একবার দাবি উত্থাপন করেছিলেন—মক্কা ও মদিনাকে মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্র সমূহের সম্মিলিত তত্ত্বাবধানে গঠিত কাউন্সিলের হাতে সোপর্দ করার জন্য।
মনে হয় খ্রিস্টান জগতের ভ্যাটিকানের ধারণাই উত্তম। ইতালির মাঝে ক্ষুদ্র একটা এলাকা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যদায় অধিষ্ঠিত ভ্যাটিক্যান সিটি। খ্রিস্ট ধর্মের যাজকেরাই এ রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধায়নে রয়েছেন। পোপ হচ্ছেন সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। অবশ্য হজরত হাফেজ্জি হুজুর ভ্যাটিক্যানের কথা বলেননি। তিনি বলেছিলেন সব দেশের মনোনীত সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত কাউন্সিলের কথা। সম্ভবত ইসলাম পোপ-ইজমে বিশ্বাস করে না বলে তিনি কাউন্সিলের প্রস্তাব করেছিলেন। হেরেম পরিচালনার দায়িত্ব বুজুর্গ ব্যক্তিদের হাতে থাকা উচিত।
সৌদি রাজ পরিবারের সে চরিত্র নেই। তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে ঘুষ, দুর্নীতি, চরিত্রহীনতার অভিযোগ এনেছেন। বর্তমান ক্রাউন প্রিন্স তাদের প্রয়োজনে সৌদি সমাজে আধুনিকতা আনার জন্য উদ্যোগ নিয়েছেন। কেউ এ উদ্যোগের বিরোধিতা করতে পারেন না। এটা সময়ের দাবি। কিন্তু আধুনিকতা পাপাচারও ডেকে আনে। পাপাচার থেকে হেরেমদ্বয়কে রক্ষা করতে হবে।
সুতরাং মুসলিম বিশ্বকে এখন পবিত্রতা রক্ষার জন্য হেরেমদ্বয়ের তত্ত্বাবধায়নের দায়িত্ব সম্মিলিত মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধি দিয়ে গঠিত কাউন্সিলের হাতে সোপর্দ করতে হবে। হেরেমদ্বয় হবে স্বাধীন সার্বভৌম।
সর্বোপরি সৌদি আরব এখন শাসিত হচ্ছে সৌদি রাজ পরিবার দ্বারা। তারা আরবের নাম পরিবর্তন করে তাদের পরিবারের নামে সৌদি আরব নামকরণ করেছেন। একটা পরিবারের নামে একটা রাষ্ট্রের নামকরণ হওয়া খুবই দৃষ্টিকটু। সৌদি রাজ পরিবার এখন তাদের পরিবারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য বহু কৌশল অবলম্বন করছে। আর তাদের রাজ পরিবারের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে গিয়ে বৃহত্তর রাষ্ট্রগুলোর ‘দালালি’ করতে হয়। এ ‘দালালি’ করতে গিয়ে তারা অধিকাংশ সময় মুসলিম বিশ্বের স্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন।
ইরান ও হিজবুল্লাহ এখন আমেরিকা এবং ইসরায়েলের চক্ষুশূল। সুতরাং সৌদি আরবেরও তারা দুশমন। এ কারণেই সৌদি বাদশা সালমান বিন আব্দুল আজিজ বলেছেন শিয়ারা মুসলমান নয়। এটা মুসলমানদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির পাঁয়তারা।
লেবাননের হিজবুল্লাহরা শিয়া। খুবই শক্তিশালী গেরিলা গ্রুপ। তাদের কারণেই লেবানন নামক রাষ্ট্রটি টিকে আছে। আগে কথায় কথায় ইসরায়েলিরা লেবাননের সীমান্ত অতিক্রম করে লেবাননে প্রবেশ করে অবস্থান নিত কিন্তু এখন হিজবুল্লাহর কারণে তা আর সম্ভব হচ্ছে না। হিজবুল্লাহর গেরিলাদের আক্রমণে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হতে হয়। হিজবুল্লাহদের অর্থকড়ি জোগান দেয় ইরান, এখন হিজবুল্লাহ ক্ষেপণাস্ত্র পর্যন্ত তৈরি করতে জানে। হিজবুল্লাহর প্রশিক্ষণ অস্ত্র সব সহায়তা আসে ইরান থেকে। জরুরি ভিত্তিতে হিজবুল্লাহর কিছু গেরিলা গিয়েছিল সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের পতন ঠেকাতে। তারা সিরিয়ার মাটি থেকে আইএসকে নির্মূল করেছে।
আইএস ছিল সৌদি আরব আর আমেরিকার যৌথ প্রজেক্ট। ইরাক থেকেও আইএস নির্মূল হয়েছে। ইরাকের মানুষ সিংহভাগ শিয়া। প্রধানমন্ত্রী আবাদিও শিয়া, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ শিয়া। বাহরাইনের আমির সুন্নি কিন্তু সিংহভাগ সাধারণ মানুষ শিয়া। ইয়েমেনে বিদ্রোহী হুতিরাও শিয়া। তারা গত সপ্তাহে রিয়াদ বিমানবন্দরে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। তারা দাবি করেছে, এই ক্ষেপণাস্ত্র তারা নিজেরাই তৈরি করেছে। খোদ সৌদি আরবের ২৫% লোক শিয়া।
কাতার সুন্নি রাষ্ট্র হলেও আরব সাগরের গ্যাস ভাগাভাগিতে কাতার ইরানের অংশীদার। গত কয়মাস আগে সৌদি আরব কাতারের ওপর অবরোধ স্থাপন করলে ইরান জরুরি ভিত্তিতে খাদ্য পাঠিয়ে তাদের সাহায্য করেছিলো। কাতারের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য তুরস্ক কাতারে সেনা মোতায়েন করে রেখেছে প্রয়োজনে ইরানও কাতারে সৈন্য পাঠাবে। কুয়েতের আমির বলেছেন সৌদি যুবরাজের আচরণ ষাঁড়ের মতো। অর্থাৎ সৌদি আরবের চারিদিকে সক্রিয় ভলকানো, মানে আগ্নেয়গিরি।
ইয়েমেনে অবরোধ করে রাখায় ইয়েমেনের বন্দরগুলো অকার্যকর হয়ে পড়েছে, যে কারণে ইয়েমেনের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে আন্তর্জাতিক ত্রাণ ইয়েমেনে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। হুতি বিদ্রোহীরা রাজধানী সানাসহ ইয়েমেনের পশ্চিম অংশ দখল করে রেখেছে। তারা যুদ্ধ করছে সৌদি সমর্থিত প্রেসিডেন্ট আবেদ রাব্বো মনসুর হাদির সরকারের বিরুদ্ধে। সৌদি আরব ইয়েমেনের বিদ্রোহীদের ওপর ২০১৫ সাল থেকে বোমা বর্ষণ করে আসছে। সৌদিদের বোমা আক্রমণের কারণে ইয়েমেনের পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে।
গত ৫ নভেম্বর থেকে বন্দর অবরোধ করে ইয়েমেনের দুর্ভিক্ষকে আরও ব্যাপক করে দিয়েছে। ত্রাণ পৌঁছাতে পারছে না ইয়েমেনে। বিশ্বের প্রেসার রয়েছে সৌদির ওপর যেন ইয়েমেনের নৌ, স্থল ও বিমানবন্দর থেকে অবরোধ প্রত্যাহার করা হয়। মানবিক কারণে সৌদি আরবের এ অবরোধ প্রত্যাহার করা উচিত। না হয় ইয়েমেনে লাখ-লাখ মানুষ অনাহারে মারা যাবে।
ভদ্রোচিতভাবে সৌদি সরকার লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরিকে অপহরণ করেছিল। তাকে ফ্রান্সে যেতে দিয়েছে এখন কিন্তু তার শিশু সন্তান রয়ে গেছে সৌদি আরবে। তিনি সৌদি আরবে গিয়ে সম্ভবতো যুবরাজের চাপে পদত্যাগ করেছেন। বলেছেন, হিজবুল্লাহর কারণে তার জীবনের নিরাপত্তায় হুমকি। অথচ তার মন্ত্রিসভায় হিজবুল্লাহর দুই প্রভাবশালী সদস্য মন্ত্রী। ২০০৫ সালে সাদ হারিরি পিতা রফিক হারিরি লেবাননের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি ২১ জন সঙ্গীসহ সমুদ্র সৈকতে বোমা হামলায় নিহত হয়েছিলেন।
রফিক হারিরিকে হিজবুল্লাহ নেতা সাঈদ হাসান নাসরুল্লাহ প্রস্তাব দেয়ছিলেন লেবাননের নব নির্মিত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের সামনে ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে আত্মাহুতি দেওয়া হিজবুল্লাহর সদস্যদের একটা স্মৃতিসৌধ নির্মাণের জন্য। কিন্তু রফিক হারিরি এই প্রস্তাবে রাজি হননি। অনেকে মনে করেন, এ কারণে হিজবুল্লাহ প্রধানমন্ত্রী রফিক হারিরিকে হত্যা করেছিলেন।
তার ছেলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি লন্ডনের দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট-এর মধ্যেপ্রাচ্যের প্রতিনিধি রবার্ট ফিস্ককে এক সাক্ষাৎকারের বলেছিলেন, তিনি মনে করেন না, তার বাবাকে হিজবুল্লাহর গেরিলারা হত্যা করেছে। হিজবুল্লাহর প্রতিরোধের কারণে লেবানন টিকে আছে। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী হিজবুল্লাহর সঙ্গে বিরোধে যাবে কেন? সৌদি আরব হিজবুল্লাহকে নিয়ে যে নাটক সাজিয়েছে, তা হয়তো সম্পূর্ণ বানোয়াট।
সৌদি রাজ পরিবারের ঐক্য ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। চারদিকের রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সৌদির সম্পর্ক কী হালে গিয়ে পৌঁছেছে বোঝানোর জন্য এত উদাহরণ দিলাম। সুতরাং সৌদি যুবরাজ এখন ব্যর্থতা নিয়ে নিশ্চয়ই হতাশায় ভুগছেন। যে কারণে ইসরায়েলের সাহায্যের দ্বারস্থ হয়েছেন তারা। ওসামা বিন লাদেন সৌদি রাজশক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলো আমেরিকার সেনা বাহিনীকে সৌদিতে ডেকে আনার কারণে। লাদেন আল-কায়েদাও গঠন করেছিলেন একই কারণে। সৌদি যুবরাজ যদি শিয়া, হিজবুল্লাহ আর ইরানকে ধ্বংস করার জন্য সৌদি আরবের ভূমিতে ইসরায়েলকে ডেকে আনে তবে ডজন ডজন লাদেন ও আল-কায়েদা আত্মপ্রকাশ করবে মুসলিম বিশ্বে। মধ্যপ্রাচ্যের রাজতন্ত্রের আয়ু শেষ বলে মনে হয়। তবে ইসরায়েল সৌদির ভূমিতে আসলে পতন তরান্বিত হবে। কেউ ঠেকাতে পারবে না।
লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক