অধ্যাপক মোঃ আনিসুর রহমান ফরাজী: নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। সুজলা, সুফলা শস্য শ্যামলার দেশ বাংলাদেশ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মন্ডিত ষড় ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। কিন্তু এমন সোনার দেশে আজ মানব সৃষ্ট দূষণ ও দখলবাজীর মাধ্যমে অনেক কিছু বিলীন হতে যাচ্ছে। তার মাঝে অন্যতম আমাদের নদী। নদীগুলির নাব্যতা ফিরিয়ে না আনার কারণে নদীগুলি শুকাচ্ছে, আর এক শ্রেণীর ভ‚মিদস্যু সেগুলি দখল করে নিচ্ছে। এগুলি রাষ্ট্রীয় সম্পদ। কি ভাবে ভ‚মিদস্যুর দখলে যাচ্ছে তা আমাদের জানার বিষয়।
বাংলাদেশের ভৌগলিক সীমানার অনুপাতে জনসংখ্যা হার বেশী এবং অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ একটি দেশ। মোগল বাদশাহী আমল থেকে প্রাচ্যের শাসনামল, এরপর পাক ভারত উপমহাদেশে বাংলার শাসক যুগে যুগে এসেছে ভিন দেশ থেকে। কিন্তু বাংলার ঐতিহ্যকে সামনে রেখে যে যার মতো তাঁদের শাসন আমল চালিয়ে গেছেন। ঐ সময়কালীন বাংলার ঐতিহ্যে ছিল ঘোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু, নদী-নালা পুকুর ভরা মাছ, ফল, শাক-সবজী, প্রাকৃতিক বনে সমৃদ্ধ আরো কত কিছু। কিন্তু কালের বিবর্তনে আজ কি হচ্ছে! কৃষকের কৃষি জমি ভূমি দস্যুরা দখলে নিচ্ছে। বিলীন হয়ে গেছে সোনালী আঁশের পাটের ঐতিহ্য। গোলায় আর ধান উঠছে না। ক্ষেতে খামারে চাষ হচ্ছে না । নানান ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে আজ সোনার বাংলাদেশ যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে!
নদীগুলি দখল করে গড়ে উঠছে বিশাল বিশাল শিল্প কারখানা, ব্যবসায়িক ও আবাসিক এলাকা। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষা, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, আরিয়াল খাঁ কোনটাই আজ ভূমি দস্যুদের চোখের আড়ালে নেই। নদীর নাব্যতা হারানোর সুযোগে এসব নদীগুলির দখল নিয়ে নিচ্ছে এক শ্রেনীর প্রভাবশালী মানুষ। গড়ে উঠছে বালু মহল, কয়লার ডিপো, ইট পাথরের ডিপো। কেউ কেউ আবার সুযোগ মতো লীজ নিচ্ছে লক্ষ লক্ষ একর জমি, এ সমস্ত নাব্যতা হারানো নদীর মাঝে সাটানো হচ্ছে বিরাট বিরাট বিলবোর্ড; নাম-বেনামে বিলবোর্ডে শোভিত হচ্ছে স্বপ্নের আবাসন, সুখী নীড়, স্বপ্নপুড়ি, নিউ হেভেন, নিকুঞ্জ, ছায়াকুঞ্জ আরো কত কি? রিভার ভিউ পার্ক, জলসা ঘর ইত্যাদিতে ছেয়ে যাচ্ছে বাংলার ঐতিহ্যবাহি নদীগুলি।
মূলধারার যে নদীগুলি আজও বেঁচে আছে, এগুলি বিষাক্ত ক্যামিকেল ও বর্জে দূষিত হয়ে যাচ্ছে। পরিবেশ ভারসাম্যহীন হয়ে যাচ্ছে, এতে মানব কুলের ধ্বংশ অবশ্ব্যম্ভাবী। প্রশ্ন হলো- এ সম্পদগুলি কার? নিয়ম মাফিক এগুলি রাষ্ট্রীয় সম্পদ হওয়ার কথা। কিন্তু কিভাবে দখলবাজরা এক এক করে দখল করে নিচ্ছেএ সমস্ত রাষ্ট্রীয় সম্পদ ? এতে কি রাষ্ট্রের কোন ভূমিকা নেই? নদী, খাল-বিল, বন, পাহাড়, কয়লাখনি সবই রাষ্ট্রীয় সম্পদ। এগুলি রক্ষণাবেক্ষণ সরকারের দায়িত্ব
রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপানায় এবং প্রশাসনিক অবকাঠামো অনুযায়ী একটি স্বাধীন দেশের সংসদ রয়েছে, সংসদীয় কমিটি রয়েছে, বিভাগ ওয়ারী মন্ত্রনালয় ও দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী, সচিব ও অন্যান্য পদ পদবীর জনবল রয়েছে। কিন্তু বাহ্যত তাদের কাজ জনস্বার্থে তেমন দেখা যাচ্ছে না। ভূমি মন্ত্রী, বন ও পরিবেশ মন্ত্রী, কৃষি মন্ত্রী, পানি সম্পদ মন্ত্রী প্রত্যেকেই নিজ নিজ দায়িত্ব নিয়ে আছেন, তবে কিভাবে বাংলার ঐতিহ্যবাহি সম্পদগুলি দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে?
আজকের মানবকুল কোন একদিন হয়ত: ধ্বংশ স্তুপে পরিণত হতে পারে! এ দিকে রাষ্ট্রীয় নজরদারী বাড়ানো একান্ত প্রয়োজন। নদী-নালাগুলি পুন:খনন করে দখল মুক্ত করতে হবে। নামে-বেনামে দখলধারীদের বিলবোর্ড, সাইনবোর্ড গুলি উঠিয়ে কৃষকদের চাষ করার সুযোগ দিতে হবে। শিল্প কারখানার বর্জ্য যাতে কোনভাবেই পরিবেশ দূষণ করতে না পারে এর যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। শিল্পকারখানার দূষিত বর্জ্যরে জন্য শোধনাঘার বাধ্যতামূলক করতে হবে। এর জন্য বন ও পরিবেশ মন্ত্রনালয়, পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়, ভূমি মন্ত্রনালয়, কৃষি মন্ত্রনালয়, পাট মন্ত্রনালয় এর সমন্বয়ে বাংলার ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহন করতে হবে। নিজ নিজ অঞ্চল ভিত্তি¡ক গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে, যাতে মধ্যসত্ব্য ভোগী, ভূমি দস্যু, জলদস্যু, বনের রাজা, পাহাড় ধ্বংসকারী; এরা যেন কোনভাবেই আর রাষ্ট্রীয় সম্পদ দখলে নিতে না পারে। বাংলার আদি ঐতিহ্য আমাদের অবশ্যই ফিরিয়ে আনতে হবে।
লেখক: অধ্যপক মোঃ আনিসুর রহমান ফরাজী
অধ্যক্ষ, ইন্টারন্যাশনাল নার্সিং কলেজ, টঙ্গী, গাজীপুর।
ইমেইল: forazy@gmail.com