শনিবার, ১৮ মে, ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১
আজকের সর্বশেষ সবখবর

যাদের বিরুদ্ধে লড়বে শ্রমিক তারাই শ্রমিকদের হুকুমের মালিক

editor
মে ১, ২০২৪ ৯:০১ অপরাহ্ণ
Link Copied!

মো. ফরিদুল ইসলাম: সেকাল ও একালের মে দিবস অনেকটা বিপরীত মেরুতে স্থান পেয়েছে।১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটের ম্যাসাকার শহিদদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে পালিত হয়। ব্রিটিশ সমাজ সংস্কারক রবার্ট ওয়েনের আহ্বানে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ট্রেড ইউনিয়নগুলো দিনে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে এক বিরাট প্রতিবাদ কর্মসূচি শুরু করে। রবার্ট ওয়েনেএকটি চমৎকার স্লোগানও ঠিক করেন ‘আট ঘণ্টা কাজ, আট ঘণ্টা বিনোদন এবং আট ঘণ্টা বিশ্রাম’।১৮৮৬ সালের ১মে শিকাগোতে দৈনিক আটঘণ্টার কাজের দাবিতে হে মার্কেটে জমায়েত হয়েছিল প্রায় ৪০ হাজার বিভিন্ন শ্রেণী পেশার শ্রমিক। যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পকারখানা ও শ্রমিক ইউনিয়ন সংগঠনগুলোর কেন্দ্র ছিল শিকাগো। সেখানে ছিলো না নির্দিষ্ট কোনো কর্মঘণ্টা ,কাজ করতে হতো বিশ্রাম হীন। এ আন্দোলন ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতারা পছন্দ না করলেও যুক্ত হতে থাকে হাজার হাজার ক্ষুব্ধ শ্রমিকরা। এতে যোগ দেয় কিছু নৈরাজ্যবাদী। যে নৈরাজ্যবাদীরা কোনো নিয়মকানুন ও আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সমাজ ব্যবস্থাকে অস্বীকার করেন। আন্দোলনকারীদেরকে ঘিরে থাকা পুলিশের প্রতি এক অজ্ঞাতনামার বোমা নিক্ষেপের পর পুলিশ শ্রমিকদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। ফলে প্রায় ১০-১২ জন শ্রমিক ও পুলিশ নিহত হয়।নিহত হয় শ্রমিক আন্দোলনের প্রধান প্রবক্তা ক্লারা জেট কিন। পরবর্তীতে আট জন নৈরাজ্যবাদী খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত হন এবং তাদের দোষ ঠিকভাবে প্রমাণের আগেই তাদের অনেককে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। এই ঘটনাগুলোর স্মরণে, ১৮৮৯ সালে ২০ দেশের সমাজকর্মী, শ্রমিক নেতা ও ট্রেড ইউনিয়নসমূহের তথা ফরাসি বিপ্লবের শতবার্ষিকীতে প্যারিসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে থেকে শিকাগো প্রতিবাদের বার্ষিকী আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশে পালনের প্রস্তাব করেন রেমন্ড লাভিনে।১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় কংগ্রেসে এই প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়। কাজের নিচু পরিবেশ, অল্প বেতন এবং দীর্ঘ কর্মঘণ্টার প্রতিবাদে ১৮৯৩ সালে সার্বিয়ার শ্রমিকরা এক মে দিবস র‍্যালি বের করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যখন দ্রুত শিল্প কারখানায় উন্নতি ঘটতে থাকে, তখন রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরও বিশ্বজুড়ে শ্রমিকরা মৌলিক চাহিদা পূরণে সংগ্রাম করতে থাকে।এর পরপরই ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে মে দিবসের দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। এঘটনা গুলো সমাজতন্ত্রী নেতাদের মধ্যে অনুপ্রেরণা জোগায়।পরে, ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে আমস্টারডাম শহরে অনুষ্ঠিত সমাজতন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এই উপলক্ষ্যে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবে দৈনিক আটঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণের দাবি আদায়ের জন্য এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বজুড়ে পয়লা মে তারিখে মিছিল ও শোভাযাত্রা আয়োজন করতে সকল সমাজবাদী গণতান্ত্রিক দল এবং শ্রমিক সংঘের (ট্রেড ইউনিয়ন) প্রতি আহ্বান জানানো হয়। সেই সম্মেলনে “শ্রমিকদের হতাহতের সম্ভাবনা না থাকলে বিশ্বজুড়ে সকল শ্রমিক সংগঠন মে মাসের ১ তারিখে ‘বাধ্যতামূলকভাবে কাজ না-করার’ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।অনেক দেশে শ্রমজীবী জনতা মে মাসের ১ তারিখকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালনের দাবি জানায় এবং অনেক দেশেই এটা কার্যকর হয়। দীর্ঘদিন ধরে সমাজতান্ত্রিক, কমিউনিস্ট এবং কিছু কট্টর সংগঠন তাদের দাবি জানানোর জন্য মে দিবসকে মুখ্য দিন হিসাবে বেছে নেয়। কোনো কোনো স্থানে শিকাগোর হে মার্কেটের আত্মত্যাগী শ্রমিকদের স্মরণে আগুনও জ্বালানো হয়ে থাকে। পূর্বতন সোভিয়েত রাষ্ট্র, চীন, কিউবাসহ বিশ্বের অনেক দেশেই মে দিবস একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন। সেসব দেশে এমনকি এ উপলক্ষ্যে সামরিক কুচকাওয়াজের আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশ এবং ভারতেও এই দিনটি যথাযথভাবে পালিত হয়ে আসছে। ভারতে প্রথম মে দিবস পালিত হয় ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে।মাদ্রাজের (বর্তমানে চেন্নাই) কমিউনিস্ট নেতা সিঙ্গার ভেলু চেট্টিয়ার তাঁর স্ত্রীর লাল শাড়ি ছিঁড়ে লাল পতাকা তৈরি করেন এবং সেই লাল পতাকা নিজের বাড়িতে উত্তোলন করে মহান মে দিবস পালন করেন।পরে মাদ্রাজের ( বর্তমান চেন্নাই) সমুদ্রতটে হাজার হাজার শ্রমিকের উপস্থিতিতে ভারতে প্রথম মে দিবস উদযাপন করা হয়। আমেরিকা ও কানাডাতে অবশ্য সেপ্টেম্বর মাসে শ্রম দিবস পালিত হয়। সেখানকার কেন্দ্রীয় শ্রমিক ইউনিয়ন এবং শ্রমের নাইট এই দিন পালনের উদ্যোক্তা। হে মার্কেটের হত্যাকাণ্ডের পর আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড মনে করেছিলেন পয়লা মে তারিখে যেকোনো আয়োজন হানাহানিতে পর্যবসিত হতে পারে। সে জন্য ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দেই তিনি নাইটের সমর্থিত শ্রম দিবস পালনের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যখন দ্রুত শিল্প কারখানায় উন্নতি ঘটতে থাকে, তখন রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরও বিশ্বজুড়ে শ্রমিকরা মৌলিক চাহিদা পূরণে সংগ্রাম করতে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পাল্টে যায় বিশ্বের মানচিত্র। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিভক্তি আরও বেশি করে নজরে আসে। বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দেশ যেমন কিউবা সেসময়কার সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনে গুরুত্বের সাথে এদিন পালিত হয়ে আসছিল বছরের পর বছর। এদিনের ছুটি ছিলো অর্থবহ। আয়োজন করা হত মহা সমাবেশের , প্রদর্শন করা হতো সামরিক বাহিনীর শক্তিমত্তা। দলমত নির্বিশেষে যোগ দিতেন বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতারা ও রাষ্ট্রের শীর্ষ ব্যক্তিবর্গ। সমাজতান্ত্রিক নেতারা বিশ্বাস করতেন এই নতুন ছুটি ও উৎসব শ্রমিকদেরকে পুঁজিবাদীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে প্রেরণা জোগাবে ও উদ্বুদ্ধ করবে। কাজেই এদিন তাদের জন্য যেমন ছিলো আনন্দের তেমনি ছিলো বেদনার ও মহৎ উদ্দেশ্যের জন্য সংকল্পবদ্ধ হওয়ার।বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শুধু আনন্দের বিষয়টি দেখা যায়। নানারকম বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে বের করা হয় র‍্যালি। র‍্যালি শেষে সারাবছরে শ্রমিকের বেতন থেকে শোষিত অর্থে রান্না করা খাবার বিতরণ করা হয়।এর কারণ হিসাবে বলতে পারি শ্রমিকগণ যাদের বিরুদ্ধে লড়বে বা লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হবে তারাই এই শ্রমিকদের নেতা।অর্থাৎ অনেকটা রক্ষক যখন ভক্ষক অবস্থার মতো। সুসীলদের মতো করে বললে এভাবেও বলতে পারি নিষ্ঠা যখন পিষ্টতার পিঠ বায় শিষ্টতা তখন দুখের প্লাবনে ভাসে।কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের সভাপতি সেক্রেটারি ও কমিটির অন্যান্য সদস্যদের নেই কোনো নির্ধারিত কর্ম। অর্থাৎ না তারা কৃষক , না তারা ইটভাটা- ইটভাঙা শ্রমিক , না তারা অটো রিকশা ড্রাইভার , না তারা সিএনজি ড্রাইভার ,না তারা বাস-ট্রাক ড্রাইভার। অবশ্য তাদেরকে সারাদিন কোনো মাঠে ঘাটে কাজ করতে দেখা না গেলেও সকাল সন্ধ্যায় চায়ের দোকানে ঠিকই পাওয়া যায়। আর সারাদিন সংগঠনের নামে চলে চাঁদাবাজি। তার উদাহরণ হতে পারে সড়ক পরিবহন শ্রমিকদের থেকে সংগঠনের নামে টোকেন সরবরাহ করে রাস্তায় দাড়িয়ে দৈনিক চাঁদা আদায়, উদাহরণ হতে পারে নির্মাণ শ্রমিকদের প্রাপ্য মজুরি থেকে সংগঠনের নাম ভাঙিয়ে কমিশন।অর্থাৎ যাদের বিরুদ্ধে লড়বে শ্রমিক তারাই তাদের হুকুমের মালিক। যার জন্য আজও সিলেটের চা শ্রমিকদের সন্তানরা পাচ্ছে না প্রাথমিক শিক্ষা। এযুগে এসেও সিলেটের কিছু অঞ্চলে দাবি ওঠে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় চেয়ে। শ্রমিকদের নেতা শ্রমিক হলে দাবি ওঠতে পারে কেবল তখনই। শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই হতে পারে তখনই। পুঁজিবাদী ব্যবসায়ী যদি হয় শ্রমিক নেতা শোষণকে রুখতে নেতৃত্ব দিতে গেলে বাঁধা আসবে এটাই স্বাভাবিক। এরমধ্যেও বিশ্বের অন্যান্য দেশে শ্রমিক ও ইউনিয়নগুলি আরও ভালো কাজের পরিবেশের দাবিতে মে দিবস ঘিরে র‍্যালি ও সমাবেশ করে। বেকারত্ব ও দারিদ্র্যতার সাথে লড়াইয়ে শ্রমিকদের অধিকারের বিষয়টি এখনো গুরুত্বের সাথে দেখা হয়ে থাকে।বেকারত্ব কমলেও এবং কাজের ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আসলেও, আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন – আইএলও তাদের ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে বলছে, বেশিরভাগ জি-২০ দেশে গত বছরের মুদ্রাস্ফীতির সাথে তাল রেখে মূল বেতন ভাতা দিতে পারে নি।আইএলও বলছে, গত বছর ক্রয়ক্ষমতা (পিপিপি) অনুযায়ী চরম দারিদ্রসীমায় থাকা শ্রমিক যাদের আয় দিনে ২.১৫ ডলারেরও কম, তাদের সংখ্যা বিশ্বব্যাপী প্রায় ১০ লাখ বেড়ে গিয়েছে।আর সহনীয় দারিদ্র্য সীমায় থাকা শ্রমিকের সংখ্যা (ক্রয়ক্ষমতা অনুযায়ী যারা দিনে ৩.৬৫ ডলারের কম আয় করেন) বিশ্বজুড়ে প্রায় ৮৪ লাখ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানিয়েছে আইএলও।

Please follow and like us:

এই সাইটে নিজম্ব নিউজ তৈরির পাশাপাশি বিভিন্ন নিউজ সাইট থেকে খবর সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট সূত্রসহ প্রকাশ করে থাকি। তাই কোন খবর নিয়ে আপত্তি বা অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট নিউজ সাইটের কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ রইলো।বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোকচিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বেআইনি।
Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial