মুহম্মদ জাফর ইকবাল: শপিং মলের খোলা একটা জায়গায় একটি সুন্দর বসার জায়গা। সেখানে তেরো-চৌদ্দ বছরের একজন কিশোরকে নিয়ে তার মা বসে আছেন। মায়ের বয়স খুব বেশি নয়, চেহারার মাঝে মার্জিত রুচিশীলতার ছাপ রয়েছে। কিশোরটিরও বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। মা হাসি হাসি মুখে তার ছেলেটিকে বললেন, ‘বাবা, ওই যে কাপড়ের দোকানটা দেখছিস?’
ছেলে বলল, ‘হ্যাঁ, মা দেখছি।’
‘ওখানে একজন মহিলা কেনাকাটা করছে, দেখেছিস?’
ছেলেটি মাথা নাড়ল, বলল, ‘হ্যাঁ মা, দেখছি।’
মা বললেন, ‘মহিলাটা তার ব্যাগ পাশে চেয়ারটার উপরে রেখেছে।’
ছেলে মাথা নাড়ল। মা তখন বললেন, ‘তুই গিয়ে ওই ব্যাগটা নিয়ে ছুটে চলে আয়।’
ছেলেটি একটু অবাক হয়ে বলল, ‘মানে ব্যাগটা চুরি করব?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ চুরি করবি।’
‘তুমি আমার মা, তুমি আমাকে চুরি করতে বলছ?’
মা হাসি হাসি মুখে বলল, ‘তুই এতো অবাক হচ্ছিস কেন? সবাই চুরি করে।’
‘যদি ধরা পড়ে যাই? সিসি ক্যামেরাতে ছবি উঠে যায়?’
‘ধরা পড়বি কেন? আর সিসি ক্যামেরাতে ছবি উঠলেও কোনও সমস্যা নেই। তোর বয়স কম, তোকে কেউ কিছু বলবে না। পত্রপত্রিকায় ছবি উঠলেও তোর মুখটা ঝাপসা করে রাখবে। কম বয়সী চোরদের চেহারা পত্রিকায় ছাপানোর নিয়ম নেই।’
মায়ের উৎসাহ পেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার কিশোরটি কাপড়ের দোকান থেকে মহিলাটির ব্যাগটি চুরি করে নিয়ে এলো। ছেলেটি যখন মায়ের কাছে ফিরে এলো, মা ছেলেটির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘বাবা, আজকে তোর চুরিতে হাতেখড়ি হলো।’
ছেলেটি হাসিমুখে বলল, ‘তুমি উৎসাহ দিয়েছ বলে পেরেছি।’
মা বললেন, ‘পরেরবার বাসা থেকে বড় চ্যালা-কাঠ নিয়ে আসব। তুই পিছন থেকে একজনের মাথায় মারবি। মানুষটা পড়ে গেলে তার হ্যান্ডব্যাগ, মানিব্যাগ সব তুলে নিয়ে আসবি। পারবি না?’
ছেলেটি উজ্জ্বল চোখে বলল, ‘কেন পারব না মা? তুমি দোয়া করো আমার জন্যে।’
মা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘সব সময় দোয়া করি। একজন মা যদি সন্তানের জন্যে দোয়া না করে তাহলে কে করবে?’
আমি জানি, পাঠকদের যারা এই পর্যন্ত পড়েছেন তারা নিশ্চয়ই খুব বিরক্ত হচ্ছেন। মা সন্তানকে নিয়ে এরকম জঘন্য একটা কাহিনি তৈরি করেছি বলে অনেকে হয়তো আমাকে শাপ-শাপান্ত করছেন।
আমি এবারে পাঠকদের আবার গল্পটা পড়তে বলব, এবারে যেখানে যেখানে ‘ব্যাগ চুরি’-এর কথা বলা হয়েছে সেখানে ‘প্রশ্ন ফাঁস’ কথাটা ঢুকিয়ে দিতে হবে। (চুরি করা অন্যায়, প্রশ্ন ফাঁসও অন্যায়। এই দুইয়ের মাঝে বিশেষ কোনও পার্থক্য নেই)। হঠাৎ করে পাঠকেরা আবিষ্কার করবেন আমার গল্পে বিন্দুমাত্র অতিরঞ্জন নেই। আমাদের দেশের মা-বাবা কিংবা শিক্ষকেরা নিজ হাতে তাদের সন্তানদের অন্যায় করার হাতেখড়ি দিচ্ছেন। বড় হয়ে যেন আরও বড় অন্যায় করতে কুণ্ঠিত না হয়, তার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ পাবার পর যখন এই সব বাবা-মায়ের ছেলেমেয়েরা গোল্ডেন ফাইভ পাবে তারা বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে মিষ্টি পাঠাবেন। চুরি করার মতো অন্যায় করা এখন রাষ্ট্রীয়ভাবে মেনে নেওয়া হয়েছে।
জেএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন প্রত্যেকদিন ফাঁস হয়েছে। পত্রপত্রিকায় তার খবর বের হয়েছে। ছবি ছাপা হয়েছে। কিন্তু কোনও পুলিশ-র্যাব-মিলিটারি-বিজিবি কাউকে ধরতে যায়নি। কোনও মোবাইল কোর্ট কাউকে বিচার করে শাস্তি দেয়নি। তেরো-চৌদ্দ বছরের ছেলেমেয়েরা ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন দেখে নিয়মিত পরীক্ষা দিচ্ছে, অথচ একটি রাষ্ট্রের কোনও মাথা ব্যথা নেই, সবাই নিরাসক্তভাবে দেখছে—এটি কেমন করে হতে পারে?
বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনা। নিয়মিত প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে এবং সেটি নিয়ে কারও কোনও মাথাব্যথা নেই। পরীক্ষার আগে ছেলেমেয়েরা আমার কাছে ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন পাঠায়। পরীক্ষা হয়ে যাবার পর তারা আমার কাছে আসল প্রশ্নটি পাঠায়, আমি অবাক বিস্ময়ে দেখি হুবহু মিলে যাচ্ছে। আমি এই অকাট্য প্রমাণ দেখিয়ে লেখালেখি করেছি কিন্তু কারও ভেতরে কোনও চিত্তচাঞ্চল্য নেই। শেষে কোনও উপায় না দেখে আমি ঠিক করলাম ‘প্রশ্ন ফাঁস মানি না মানব না’ লিখে একটা প্ল্যাকার্ড নিয়ে প্রতিবাদ হিসেবে শহীদ মিনারে বসে থাকব। আমার প্রতি মায়া দেখিয়ে আমার কয়েকজন বন্ধুবান্ধব, পরিচিত মানুষ এবং বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অল্প কিছু ছেলেমেয়ে আমার সঙ্গে ছিল। (মজার কথা, আমি যে প্ল্যাকার্ডটি নিয়ে বসেছিলাম তার বক্তব্য একটু পরিবর্তন করে আমার একটা ছবি নেটওয়ার্কে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল) পরে শুনেছি আরও কিছু ছেলেমেয়ে শহীদ মিনারে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের ভয় দেখানো হয়েছিল বলে তারা সাহস করে আসেনি! টেলিভিশনের অনেক চ্যানেল এসেছিল, তারা নিশ্চয় অল্পবিস্তর প্রচারও করেছিল। তার ফলে কিছুদিনের ভিতরে তদন্ত কমিটি হলো, তারা তদন্ত করলেন। বড় বড় সরকারি কর্মকর্তারা আমার বাসাতেও এসে আমার বক্তব্য শুনে গেলেন। সমস্যাটা সমাধানের পথ খুঁজে বের করার জন্যে দেশের বড় বড় শিক্ষাবিদদের নিয়ে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী সচিবালয়ে একটা মিটিং ডাকলেন।
মিটিংয়ের এজেন্ডাতে ‘প্রশ্ন ফাঁস’ কথাটি নেই, সামগ্রিকভাবে শিক্ষাব্যবস্থার সমস্যার কথা বলা হয়েছে। তাই খুবই স্বাভাবিকভাবে দেশের বড় বড় বর্ষীয়ান শিক্ষাবিদেরা দেশের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার সমস্যা নিয়ে আলোচনা শুরু করলেন। দেশের বড় বড় শিক্ষাবিদেরা রিটায়ারর্ড করার পর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হয়ে যান। তাই কিছুক্ষণের মাঝেই আলোচনা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যার দিকে মোড় নিল। আমি ততক্ষণে বুঝে গিয়েছি প্রশ্নফাঁসের ব্যাপারটা চাপা পড়ে গিয়েছে। বড় বড় শিক্ষাবিদ যারা এসেছেন, তাদের কাছে প্রশ্নফাঁস গুরুত্বপূর্ণ কোনও ইস্যু নয়। আমি ততক্ষণে ঠিক করে নিয়েছি কোনও কথা না বলে বিদায় নেব। মিটিংয়ের শেষের দিকে শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় নিজে আমাকে কিছু বলতে অনুরোধ করলেন। আমি কিছু বললাম, অন্যেরাও কিছু বললেন, আলোচনা শেষ! তখন কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল এতোদিন পর আমার আর সেটি মনে নেই, কিন্তু এটুকু সবাই জানে যে সমস্যাটির সমাধান হয়নি। এখনো নিয়মিতভাবে প্রশ্নফাঁস হয়ে যাচ্ছে। ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন দেখে পরীক্ষা দেওয়া অন্যায়। সারা পৃথিবীতে অন্যায় কাজ করা হয় গোপনে, শুধু আমাদের দেশে এটি করা হয় প্রকাশ্যে। কী লজ্জা! কী লজ্জা!
প্রশ্নফাঁসের ব্যাপারটি আমাকে যেটুকু আহত করে, তার থেকে বেশি আহত করে এই পুরো ব্যাপারটি নিয়ে দেশের বড় বড় মানুষের নির্লিপ্ততা। এই দেশে কতো শিক্ষক, শিক্ষক সংগঠন, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, ভাইস চ্যান্সেলর, কোর্ট, হাইকোর্টের বিচারপতি, সাংবাদিক, সম্পাদক, কতো পুলিশ, র্যাব, মিলিটারি, কতো সাংসদ, মন্ত্রী, কতো বুদ্ধিজীবী, কতো রাজনৈতিক নেতা—কিন্তু কেউই জোর গলায় এর প্রতিবাদ করছেন না। কিন্তু একটা জাতির জন্যে এটা যে কতো বড় একটা বিপর্যয়—সেটা কি কেউ ভেবে দেখেছেন? এ দেশের একটা শিশু বড় হচ্ছে অন্যায় করতে শিখে! পুলিশ কাউকে ধরতে পারে না, অথচ আমার কাছে স্কুলের শিশুরা নিয়মিত চিঠি লিখে জানায় কে কোন সেন্টারে পরীক্ষা দিচ্ছে, সেই সেন্টারের কোন শিক্ষক কিভাবে কোন স্কুলের ছেলেমেয়ের কাছে প্রশ্নফাঁস করে দিচ্ছেন, তার উত্তর বলে দিচ্ছেন। একটা স্কুলের বাচ্চারা যে অপরাধীদের চেনে, এ দেশের পুলিশ মিলিটারি র্যাব মিলে সেই অপরাধীদের ধরতে পারে না—এটা আমি কেমন করে বিশ্বাস করি? তাই আমাকে মেনে নিতেই হচ্ছে, যারা প্রশ্নফাঁস করছে তাদের ধরার ব্যাপারে কারও কোনও আগ্রহ নেই।
একেবারে প্রথম দিন থেকে আমি যে কথাটা বলে আসছি, এখনও আমি সেই একই কথা বলছি! একটা সমস্যা সমাধান করতে হলে প্রথমে সমস্যাটা বুঝতে হবে। সমস্যাটা বুঝতে পারলেই সমস্যার অর্ধেক সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু সেই সমস্যাটা যদি কেউ বুঝতেই না পারে তাহলে তার সমাধানটা হবে কেমন করে? প্রশ্নফাঁসের সমস্যা সমাধানটা হচ্ছে না ঠিক এই কারণে। এখন পর্যন্ত কেউ সমস্যাটা বোঝার পর্যায়েই যায়নি। কেমন করে যাবে? তাহলে স্বীকার করতে হবে প্রশ্নটা ফাঁস হয়েছে। কেমন করে স্বীকার করবে প্রশ্নফাঁস হয়েছে? তাহলে পরীক্ষাটি বাতিল করতে হবে। কাজেই কখনোই ঘোষণা দিয়ে স্বীকার করা হয়নি প্রশ্নফাঁস হয়েছে, যেহেতু প্রশ্নফাঁস হয়েছে বলা হয়নি—তাই যারা প্রশ্নফাঁস করেছে তাদের অপরাধী বলার সুযোগ নেই। বরং আমি উল্টোটা হতে দেখেছি, যখন কেউ প্রশ্নফাঁস হয়েছে বলে চিৎকার করেছে, তখন তাকেই গুজব ছড়ানোর অভিযোগে শাস্তি দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছে। অথচ খুব সহজে প্রশ্নফাঁস বন্ধ করা সম্ভব। শুধুমাত্র শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ঘোষণা দিতে হবে, ‘যা হবার হয়েছে এই দেশের মাটিতে ভবিষ্যতে আর কখনও প্রশ্নফাঁস হবে না।’ কিন্তু আমি অনেকবার অনুরোধ করেও তাদের মুখ থেকে এই ঘোষণাটি বের করতে পারিনি। অথচ আমি নিশ্চিতভাবে জানি, এ সমস্যাটি সমাধান করা সম্ভব। এই দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আগ্রহ আছে, ভালোবাসা আছে—এ রকম অসংখ্য মানুষ রয়েছেন, প্রযুক্তিবিদ রয়েছেন, অসংখ্য তরুণ- তরুণী আছেন যারা সাহায্য করার জন্যে প্রস্তুত। শুধু তাদের সাহায্য নিতে হবে। যখন দেশে বন্যা হয়, ঘূর্ণিঝড় হয় তখন দেশের সব মানুষ সাহায্য করার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই সমস্যাটি বন্যা ঘূর্ণিঝড় থেকেও বড় বিপর্যয়—এর সমাধানে দেশের মানুষ এগিয়ে আসবে না আমি বিশ্বাস করি না।
আমি এই লেখাটি আশার কথা দিয়ে শেষ করতে চাই—আমি আশাবাদী মানুষ, আমি দেখেছি আমার জীবনে আমার কোনও আশাই বিফলে যায়নি।
কয়েক বছর আগের কথা। একটি মেয়ে আমাকে একটি ই-মেইল পাঠিয়েছে। খুবই মন খারাপ করা ই-মেইল। সে লিখেছে তার আশে-পাশে যত ছেলেমেয়ে আছে তারা সবাই ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন দেখে দেখে পরীক্ষা দিয়েছে। এই মেয়েটি কখনও কোনও প্রশ্ন দেখেনি। কারণ, সে পণ করেছে অন্যায় করবে না, ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন দেখবে না। কাজেই সবার পরীক্ষা খুব ভালো হচ্ছে। যে প্রশ্নে পরীক্ষা দেবে, সেই প্রশ্ন আগে থেকে জানা থাকলে পরীক্ষা ভালো না হয়ে উপায় কী? মেয়েটি তার ই-মেইলে লিখেছে সবার পরীক্ষা খুবই ভালো হচ্ছে শুধু তার পরীক্ষা সে রকম ভালো হয়নি। বিশেষ করে পদার্থবিজ্ঞানের পরীক্ষাটি বেশি খারাপ হয়েছে, কারণ প্রশ্নটি বাড়াবাড়ি কঠিন হয়েছে। পরীক্ষার খবর দেওয়ার পর মেয়েটি লিখেছে যেহেতু তার এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল যথেষ্ট ভালো হবে না, তাই সম্ভবত সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ারই সুযোগ পাবে না। যেহেতু কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে না তাই তাকে হয়তো কোনও কলেজে যেন-তেনভাবে লেখাপড়া শেষ করে একটি প্রাইমারি স্কুলে মাস্টারি করে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে হবে। তার স্বপ্ন দেখা শেষ। মেয়েটির ই-মেইলের উত্তরে তাকে আমি সান্ত্বনা দিয়ে কী লিখব বুঝতে পারছিলাম না, কারণ সে যে কথাগুলো লিখেছে সেটি সত্যি। ‘কোনোভাবে অন্যায় করব না’—পণ করার কারণে এই দেশে একটি ছেলে বা মেয়ের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসতেই পারে! অনেক চিন্তা করে আমি মেয়েটিকে লিখলাম, প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দেওয়া নিয়ে তুমি মন খারাপ করো না। আমিও ঠিক করেছি রিটায়ার্ড করার পর প্রত্যন্ত কোনও গ্রামে একটা প্রাইমারি স্কুল খুঁজে বের করে সেখানে মাস্টারি করে জীবন কাটিয়ে দেব। তুমি আর আমি মিলে একই স্কুলে মাস্টারি করব, সমস্যা কী? আমার এই উত্তরে কাজ হলো, বুঝতে পারলাম—সে মহা খুশি! প্রাইমারি স্কুলে মাস্টারি করার জন্যে তখন আমরা দুইজনেই মানসিক প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছি।
তারপর অনেকদিন কেটে গেছে। হঠাৎ একদিন সেই মেয়েটির আরেকটি ই-মেইল এসেছে। সেখানে সে লিখেছে, ‘স্যার আমি শেষ পর্যন্ত বেশ কয়েকটা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পেয়েছি। মজার কথা কী জানেন, আমি যতগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছি সবগুলোতে চান্স পেয়েছি। আর আমার পরিচিত বন্ধু-বান্ধব যারা ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে অনেক ভালো রেজাল্ট করেছিল, তাদের কেউ কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পায়নি!’
আমার সাথে সেই মেয়েটির প্রাইমারি স্কুলে মাস্টারি করার পরিকল্পনাটা সম্ভবত আপাতত স্থগিত হয়ে আছে। কিন্তু আমি খুব খুশি হয়েছি দুই কারণে। প্রথমত ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে পরীক্ষার ফলাফল হয়তো ভালো করা যায়, কিন্তু তাতে জীবনের কোনও লাভ হয় না—সেটি খুব ভালোভাবে প্রমাণিত হলো। দ্বিতীয়ত, অন্যায় না করে মাথা উঁচু করে থাকার মাঝে বিশাল একটা মর্যাদার ব্যাপার আছে সেটিও সবাইকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো সম্ভব হলো।
আমি আশা করে আছি আমাদের দেশের সব ছেলেমেয়ে এরকমভাবে মাথা উঁচু করে থাকবে। এবং এই ছেলেমেয়েদের উঁচু করে থাকা মাথাকে ভূলুণ্ঠিত করার জন্যে যেন কোনও কোচিং সেন্টার, কোনও শিক্ষক কিংবা কোনও দায়িত্বহীন অভিভাবক তাদের ধারে-কাছে আসতে না পারে।
যদি এটুকু আমরা নিশ্চিত করতে না পারি তাহলে দেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখব কেমন করে? আমরা তো দুঃস্বপ্ন দেখতে চাই না, স্বপ্ন দেখতে চাই।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, শিক্ষক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট