
শুভ দেব চাকমা, রাঙ্গামাটি : পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের একটি নির্ধারিত সভা অস্পষ্ট হুমকির কারণে স্থগিত হওয়ায় দেশের শীর্ষস্থানীয় মানবাধিকার কর্মী, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও সমাজকর্মীরা তীব্র নিন্দা ও হতাশা প্রকাশ করেছেন। এ ঘটনাকে তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের প্রতি রাষ্ট্রের অঙ্গীকারে একটি বড় ধরনের ফাটল হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় ভূমি বিরোধের নিষ্পত্তির জন্য গঠিত হওয়ার ২৪ বছর পরও কমিশনটি তার মূল উদ্দেশ্যেই ব্যর্থ বলে মন্তব্য করেছেন ৩৩ বিশিষ্ট নাগরিকের একটি সম্মিলিত প্রেস বিবৃতিতে। তারা উল্লেখ করেন, ২০১৬ সালে আইন সংশোধনের পর মাত্র কয়েকটি সভা হয়েছে এবং বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এখনো কাগজে-কলমেই রয়ে গেছে। কমিশনে এ পর্যন্ত ২৬ হাজারেরও বেশি ভূমি বিরোধের আবেদন জমা পড়লেও, এসব নিষ্পত্তিতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে প্রয়োজনীয় জনবল, বরাদ্দ ও প্রশাসনিক সহায়তা deliberately (সচেতনভাবে) অবহেলিত হয়েছে।
বিবৃতিতে অভিযোগ করা হয়, নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান বিচারপতি মোহাম্মদ আব্দুল হাফিজ 'রাঙামাটি সচেতন নাগরিক সমাজ' নামক একটি গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে দেওয়া অবরোধের হুমকির কাছে নতি স্বীকার করে ১৯ অক্টোবরের সভা স্থগিত করেন। নাগরিক পক্ষের মতে, এই হুমকির পেছনে সরকারের অভ্যন্তরের একটি প্রভাবশালী ও চুক্তি-বিরোধী গোষ্ঠীর সরাসরি ইন্ধন কাজ করছে, যারা দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে শান্তি প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বিবৃতিতে বলা হয়, "এই সভা স্থগিত করা পার্বত্য অঞ্চলের শান্তি প্রক্রিয়ার প্রতি একটি সুস্পষ্ট অঙ্গীকারভঙ্গ। ভূমি বিরোধের অন্ধকারে পার্বত্য এলাকায় একের পর এক সাম্প্রদায়িক হামলা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, নারী নির্যাতন, হত্যা ও মিথ্যা মামলা চলমান। কিন্তু লক্ষ্যণীয় যে, সেনানিবাস ও সুরক্ষা ক্যাম্পের সংখ্যা বাড়লেও সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাহীনতা বেড়েই চলেছে।"
তারা আরও যোগ করেন, "ভূমি বিরোধের স্থায়ী সমাধান না ঘটিয়ে পাহাড়ি জনগণের ওপরই বারবার দায় চাপিয়ে দমননীতির প্রয়োগ করা হচ্ছে। এর ফলে সেখানে ভয়, অবিশ্বাস ও গভীর বঞ্চনার সংস্কৃতি শক্তিশালী হচ্ছে, যা কখনোই স্থায়ী শান্তির সহায়ক নয়।"
এ পরিপ্রেক্ষিতে, নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে দুটি জরুরি দাবি উত্থাপন করা হয়েছে:
১.ভূমি কমিশনের সভা বারবার স্থগিত করার পেছনের সত্যিকার কারণ ও চক্রান্ত উন্মোচন করতে উচ্চপর্যায়ের একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে।
২.সরকারের অভ্যন্তরের প্রভাবশালী চুক্তি-বিরোধী গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করে তাদের দ্রুত ও কঠোরভাবে আইনের আওতায় আনতে হবে।
বিবৃতিতে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়, "কোনো সরকার বা তার মধ্যে অবস্থানকারী কোনো শক্তিশালী গোষ্ঠীই তাদের কাজের জন্য জবাবদিহিতা থেকে মুক্ত থাকতে পারে না। ২০২৪-এর জুলাই মাসের অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা এই সত্যটিই পুনর্বার সমগ্র জাতির কাছে উন্মোচিত করেছে।"
বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারী বিশিষ্ট নাগরিকদের মধ্যে রয়েছেন সুলতানা কামাল, খুশী কবির, ড. ইফতেখারুজ্জামান, দীপায়ন খীসা, শিরীন পারভীন হক, শাহীন আনাম, শামসুল হুদা, সুব্রত চৌধুরী, অ্যাডভোকেট তাসলিমা ইসলাম, ড. জোবাইদা নাসরীন, পল্লব চাকমা, মনিন্দ্র কুমার নাথ, সালেহ আহমেদ, রেজাউল করিম চৌধুরী, হানা শামস আহমেদ ও মুক্তাশ্রী চাকমা প্রমুখ।
বিবৃতিটি প্রেরণ করেন অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি)-এর নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা।