শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪, ১২ শ্রাবণ, ১৪৩১
আজকের সর্বশেষ সবখবর

পোপের ‘রোহিঙ্গা’ উচ্চারণ না করার নেপথ্যে

editor
নভেম্বর ২৯, ২০১৭ ১:০৪ অপরাহ্ণ
Link Copied!

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: গত আগস্টের শেষের দিকে রোহিঙ্গা শরণার্থী সঙ্কট শুরুর আগেই পোপ ফ্রান্সিসের মিয়ানমার সফরের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়। পোপের সঙ্গে মিয়ানমারের কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়ন ও ক্ষুদ্র রোমান ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের অবস্থার পরিবর্তনই ছিল এর উদ্দেশ্য; যাদের অনেকেই ঝুঁকিপূর্ণ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। ন্যায়পরায়ণ ধর্মীয় নেতার চেয়ে একজন কূটনীতিক এবং রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে মিয়ানমার সফরে গেছেন পোপ। কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত প্রত্যাশা অনুযায়ী কথা বলেননি; কথা বলেছেন রোহিঙ্গাদের সম্বোধন করা ছাড়াই।
এক দশক আগে সেনাশাসনের কেন্দ্রবিন্দু দেশটির রাজধানী নেইপিদোতে তিনি ভাষণ দিয়েছেন। এই সেনাবাহিনীই এখনো মিয়ানমারের চালকের আসনে আছে। রোহিঙ্গাদের দুঃখ, দুর্দশা ও অধিকারের সামান্য ছোঁয়া পোপের ভাষণে পাওয়া গেছে। সেটি হচ্ছে তিনি বলেছেন, যারা দাবি করেন তাদের বাড়ি-ঘর এই দেশের মাটিতে; তাদের অধিকারের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা নিশ্চিত করতে হবে, গণতান্ত্রিক শাসন-ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য প্রত্যেক ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর অধিকার ও তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে; কাউকে বাদ দেয়া যাবে না।
কিন্তু রোহিঙ্গাদের নাম মুখে না এনে ভাষণ দিয়ে পোপ ফ্রান্সিস মিয়ানমারের কট্টরপন্থী বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীদের সহিংস প্রতিক্রিয়া এড়িয়ে গেছেন। একই সঙ্গে দেশটির নেত্রী অং সান সু চির জন্য কোনো ধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতিও তৈরি করতে চাননি তিনি। বিবিসির দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া প্রতিনিধি জোনাথন হেড এক বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে বলেছেন, সু চি এখন ক্যাথলিক এই ধর্মগুরুর সফরকে সফল বলে দাবি করতে পারেন।
অং সান সু চির সমর্থকরা যুক্তি দিচ্ছেন যে, তার নীরবতায় পশ্চিমা বিশ্বের সমালোচনা শেষ হয়েছে। তবে সেনাবাহিনীর সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের ক্ষমতার লড়াইয়ের সাম্প্রতিক সময়ের একমাত্র দুর্বল দিক হচ্ছে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর অভিযানকে জাতিগত নিধন হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের দেয়া তকমা।
তবে সু চির নীরবতার সমালোচনায় অনেকেই বলছেন, এটি হচ্ছে তারে এক ধরনের অজুহাত। আসলে তিনি দেশটিতে অপ্রিয় রোহিঙ্গাদের সঙ্কটকে গুরুত্ব দেননি। কিন্তু পোপ হয়তো ওই যুক্তি শুনবেন এবং দেশটিতে খ্রিস্টানদের ‘ঝুঁকির’ বিষয়টিও বিবেচনায় নেবেন।
জোনাথন হেড বলেছেন, কট্টরপন্থী একজন সন্ন্যাসী তাকে বলেছেন যে, তিনি রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহারে অভ্যস্ত এবং অনেকে বৌদ্ধ মনে করেন, সেনাবাহিনী এবং সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রোহিঙ্গাদের প্রতি খ্রিস্টানদের নীরব সমর্থন রয়েছে।
রোহিঙ্গাদের প্রতি নমনীয়তা না থাকায় দেশটির সেনাবাহিনীর প্রধান মিন অং হ্লেইং ও অতি-জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধ সন্ন্যাসী সিতাগু সায়াদের সঙ্গে পোপের বৈঠক ছিল অনেক কঠিন। এই দুই প্রভাবশালী ব্যক্তি রোহিঙ্গাদের বিতাড়নে গুরুত্বপূর্ণ কলকাঠি নাড়ছে।
গত ২৫ আগস্ট রাখাইনে এক ডজনের বেশি পুলিশ ও সামরিক তল্লাশি চৌকিতে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সদস্যদের হামলার জেরে রোহিঙ্গা বিতাড়নের সামরিক অভিযানে সেনাবাহিনীর সঙ্গে জোরালো ভূমিকা রেখেছে সিতাগু সায়াদের অনুসারীরা। তার নেতৃত্বে উগ্র রাখাইন বৌদ্ধ ও মগরা নির্বিচারে রোহিঙ্গাদের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। সেনাবাহিনীর অভিযানে সহায়তা করছে বিভিন্ন সময়ে রোহিঙ্গাবিরোধী উসকানি দাতা হিসেবে চিহ্নিত বিতর্কিত এই সন্ন্যাসী।
ইয়াঙ্গুনে মঙ্গলবার এক বৈঠকে রোহিঙ্গা মুসলিমবিরোধী জাতিগত বিদ্বেষের উসকানি দাতা ওই বৌদ্ধ নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন পোপ ফ্রান্সিস। মঙ্গলবার ভ্যাটিকানের মুখপাত্র গ্রেগ বার্ক বলেন, ইয়াঙ্গুনে মিয়ানমারের ক্যাথলিক আর্চ বিশপের বাসভবনে আন্তঃধর্মীয় বৈঠকের ফাঁকে বৌদ্ধ নেতা সিতাগু সায়াদ’র সঙ্গে সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎ করেছেন পোপ।
গ্রেগ বার্ক বলেন, তাদের এই সাক্ষাৎ ছিল ‘শান্তি ও ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সহাবস্থানকে উত্সাহিত করার একটি প্রচেষ্টার কৌশল মাত্র।
দেশটিতে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নেই। এছাড়া রাখাইনে সাম্প্রতিক ব্যাপক সমালোচিত সেনা অভিযানের লক্ষ্য করা হয়েছে তাদের। এর আগে বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে পোপ ফ্রান্সি রোহিঙ্গা শব্দটি উচ্চারণ করেছিলেন। সর্বশেষ গত ২৭ আগস্টও তিনি এক সমাবেশে রোহিঙ্গা শব্দটি উচ্চারণ করে তাদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ নিপীড়ন বন্ধের আহ্বান জানান। এর একদিন পর ভ্যাটিকানের মুখপাত্র গ্রের্গ বার্ক পোপের মিয়ানমার সফরের তথ্য নিশ্চিত করেন।
কিন্তু ২৮ নভেম্বর মিয়ানমারের রাজধানী নেইপিদোতে দাঁড়িয়ে পোপের দেয়া ভাষণে রোহিঙ্গা শব্দটি একবারের জন্যও শোনা যায়নি। দেশটির সরকারি কর্মকর্তা ও কূটনীতিকদের সামনে দেয়া ভাষণে সু চিও রোহিঙ্গা শব্দটি এড়িয়ে গেছেন।
২ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ সফরের সময় সেখানে রোহিঙ্গা শরণার্থী সম্প্রদায়ের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন পোপ। অনেকেই প্রত্যাশা করছেন এই সময় হয়তো রোহিঙ্গা শব্দটি পোপের মুখে শোনা যেতে পারে।
ওপি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর সাউথ-ইস্ট এশিয়ান স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক ও সহযোগী অধ্যাপক ড. নেহজিনপ্যাও কিপজেন বলেন, পোপ মিয়ানমার সফরে এসে এক ধরনের মিশ্র বার্তা দিলেন। তার এই সফরকে দুই রাষ্ট্রের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারে একটি সফল সফর হিসেবে দেখা যেতে পারে। এবং সংখ্যালঘু ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের জন্য পোপের এই সফর ঐতিহাসিক এবং আনন্দঘন; সেদিক থেকেও।
তবে গতকাল মঙ্গলবার ছিল অনেক এনজিও ও মানবাধিকার সংস্থার জন্য একটি দুর্ভাগ্যজনক দিন। বিশেষ করে রোহিঙ্গা সম্প্রদায় এবং তাদের সমর্থকদের জন্যও। কারণ রোহিঙ্গা শরণার্থীরা-সহ মানবাধিকার গোষ্ঠী ও দাতা সংস্থাগুলোও চেয়েছিল, ক্যাথলিক এই ধর্মগুরু তার ভাষণে রোহিঙ্গাদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে আশার বাণী শোনাবেন অথবা এই সঙ্কটকে বিশ্ববাসীর সামনে গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই আশায় আপাতত গুঁড়েবালি।

Please follow and like us:

এই সাইটে নিজম্ব নিউজ তৈরির পাশাপাশি বিভিন্ন নিউজ সাইট থেকে খবর সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট সূত্রসহ প্রকাশ করে থাকি। তাই কোন খবর নিয়ে আপত্তি বা অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট নিউজ সাইটের কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ রইলো।বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোকচিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বেআইনি।
Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial