আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ভারতে শীর্ষস্থানীয় আইনজীবীদের অনেকে বলছেন, একজন সাবেক বিচারপতির বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির মামলাকে কেন্দ্র করে দেশের বিচারবিভাগ এক গভীর সঙ্কটে পড়েছে। অভিযোগ উঠেছে, ভারতের প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র এই মামলায় তার ক্ষমতার ‘চূড়ান্ত অপব্যবহার’ করেছেন।
তবে বিচারবিভাগে দুর্নীতির দিকে ইঙ্গিত করে ভারতের দুই সিনিয়র আইনজীবী, কামিনী জয়সওয়াল ও প্রশান্ত ভূষণ শীর্ষ আদালতে যে আবেদন করেছিলেন, সেটি খারিজ করে দিয়ে মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্ট তাদের তীব্র ভর্ৎসনা করেছে।
কিন্তু তারপরও এই বিতর্ক থামার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ঠিক কী নিয়ে এই বিতর্ক?
এই মামলাটি আসলে ভারতে বেআইনিভাবে মেডিক্যাল কলেজের রেজিস্ট্রেশন পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগকে ঘিরে, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই যার তদন্ত করছে। গত সেপ্টেম্বর মাসে ওড়িশা হাইকোর্টের একজন সাবেক বিচারপতি আই এম কুদ্দুসিকে তারা এই তদন্তের সূত্র ধরে গ্রেপ্তারও করেছিল।
এই অভিযুক্তরা ঘুষ নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট থেকে মেডিক্যাল কলেজগুলোর অনুকূলে রায় বের করে আনবেন বলে কথা দিয়েছিলেন, সিবিআই তল্লাসিতে সেই ঘুষের ২ কোটি রুপি উদ্ধারও হয়েছিল। কিন্তু পরে সেই সাবেক বিচারপতি জামিন পেয়ে যান।
তারপর এই মামলায় বিশেষ তদন্তকারী দল গঠনের দাবি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে পিটিশন দাখিল করেন আইনজীবী কামিনী জয়সওয়াল ও প্রশান্ত ভূষণ।
সেই সঙ্গেই তারা বলেন, যে বেঞ্চ এই আবেদন শুনবে তাতে যেন প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রকে না-রাখা হয়।
কারণ তিনি এ বছরের গোড়ার দিকে মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া সংক্রান্ত একাধিক মামলা শুনেছিলেন, আর ফলে এক্ষেত্রে একটা স্বার্থের সংঘাত বা ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ হতে পারে।
প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগটা কী?
প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে মূল অভিযোগটা হল, তিনি এই আবেদনের শুনানিতে অবাঞ্ছিতভাবে হস্তক্ষেপ করেছেন এবং এটা নিশ্চিত করেছেন যে কেবলমাত্র তার পছন্দের বিচারপতিরাই যাতে বিচারবিভাগের দুর্নীতি সংক্রান্ত এই স্পর্শকাতর মামলাটা শুনতে পারেন।
কামিনী জয়সওয়ালের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের একজন সিনিয়র বিচারপতি, জাস্টিস চেলমেশ্বর বিষয়টিকে পাঁচ বিচারপতির এক সাংবিধানিক বেঞ্চে রেফার করে দিয়েছিলেন।
কিন্তু পরদিন নাটকীয়ভাবে প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র সেই বেঞ্চ খারিজ করে দিয়ে নিজের পছন্দ অনুযায়ী আর একটি পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ গঠন করে দেন।
ভারতীয় বিচারবিভাগের ইতিহাসে প্রধান বিচারপতি এভাবে হস্তক্ষেপ করে বেঞ্চ পাল্টে দিচ্ছেন এবং নিজের পছন্দের বিচারপতিদের সেখানে দায়িত্ব দিচ্ছেন – এমন ঘটনা নজিরবিহীন।
বিশেষ করে এতে আরও চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে এই কারণে যে ওড়িশা হাইকোর্টের সাবেক বিচারপতি আই এম কুদ্দুসি সুপ্রিম কোর্টের যে বিচারপতিদের ঘুষ দেওয়ার জন্য অভিযুক্ত, সেই মামলাও শুনেছিলেন জাস্টিস দীপক মিশ্র। এবং তিনি নিজেও ওড়িশা রাজ্যেরই লোক।
এই ঘটনায় ভারতের সুপরিচিত সাংবিধানিক বিশেষজ্ঞ ও আইনজীবীরা অনেকেই মুখ খুলেছেন এবং সরাসরি প্রধান বিচারপতির সমালোচনা করেছেন – যেটা সে দেশে একেবারেই বিরল।
দেশের প্রাক্তন আইনমন্ত্রী শান্তি ভূষণ যেমন বলছেন, প্রধান বিচারপতি যেভাবে জাস্টিস চেলমেশ্বরের গঠন করা বেঞ্চ ভেঙে দিয়েছেন সেটা করার কোনও এক্তিয়ারই তার নেই – এবং এটা এ দেশে সুপ্রিম কোর্ট তথা বিচারবিভাগের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব গুরুতর প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।
সিনিয়র আইনজীবী দুষ্যন্ত দাভে মনে করছেন, প্রধান বিচারপতির আচরণ দেশে আইনের শাসনের অমর্যাদা ছাড়া কিছুই নয় এবং এতে সুপ্রিম কোর্টের বিশ্বাসযোগ্যতাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টে প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে প্র্যাকটিস করা আইনজীবী রাজু রামচন্দ্রন আবার বলছেন, তার গোটা কেরিয়ারে এত কুৎসিৎ ও হতাশাব্যঞ্জক ঘটনা তিনি আগে কোনও দিন দেখেননি।
সুপ্রিম কোর্টেরই সাবেক এক বিচারপতি সন্তোষ হেগড়ে মন্তব্য করেছেন, দেশের বিচারবিভাগের কাজের নমুনা যদি এই হয় তাহলে শুধু ঈশ্বরই ভারতকে রক্ষা করতে পারেন।
এরা প্রত্যেকেই এ কথাগুলো বলেছেন রীতিমতো কলাম বা নিবন্ধ লিখে – যা থেকে বোঝা যায় তারা এই সঙ্কটকে ভারতের বিচারবিভাগের জন্য কত গভীর বলে মনে করছেন। সূত্র: বিবিসি।