বিনোদন ডেস্ক: ভারতে ধনী ও প্রভাবশালীরা সাধারণত বিচারের ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যান, এটাই দস্তুর। অভিযুক্ত যদি সেলিব্রিটি বলে পরিচিত হন, তাহলে তো কথাই নেই। বলিউডের মেগা সুপারস্টার সালমান খান ঠিক এই গোত্রে পড়েন, আর তাই বছর কয়েক আগে মত্ত অবস্থায় গাড়ি চালিয়ে ফুটপাথে মানুষ চাপা দেওয়ার অভিযোগেও তিনি যখন পার পেয়ে যান, কেউ খুব একটা অবাক হয়নি।
কিন্তু সেই একই ব্যক্তিকে যখন ২০ বছর আগে দুটো কালো হরিণ মারার ঘটনায় বৃহস্পতিবার (৫ এপ্রিল) যোধপুরের কেন্দ্রীয় কারাগারে যেতে হলো এবং ধর্ষণে অভিযুক্ত আশারাম বাপুর মতো দাগীদের সঙ্গে যাকে রাত কাটাতে হবে, তখন ভারতে অনেকেই ভাবছেন, ঠিক শুনছি তো? হ্যাঁ, তারা ঠিকই শুনছেন, আর এই অসম্ভবকে সম্ভব করার পেছনে আছে বিশনোই নামে একটি সম্প্রদায়ের ধর্মবিশ্বাস, প্রকৃতিপ্রেম আর অকল্পনীয় জেদ।
বিশনোই হলো রাজস্থানের একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়, পঞ্চদশ শতকে বিকানেরের গুরু জম্ভেশ্বর যার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রকৃতি ও প্রাণীদের রক্ষা ও ধর্মাচরণের জন্য তিনি ২৯টি বিধান দিয়ে গিয়েছিলেন। এই ২৯টি, অর্থাৎ বিশ + নয়টি বিধান মেনে চলেন বলেই তার অনুগামীরা ‘বিশনোই’ বলে পরিচিত।
প্রাণীহত্যা করা বা বৃক্ষচ্ছেদন বিশনোইদের কাছে গর্হিত অপরাধ বা পাপ বলে গণ্য হয়। কারণ সেটাই তাদের গুরুর নির্দেশ। তারা নিরামিষাশী, কোনও প্রাণীর মাংস তারা ছুঁয়েও দেখেন না। এমনকি কোনও হরিণশিশু মা-কে হারালে বিশনোই মা তাকে নিজের বুকের দুধ দিতেও দ্বিধা করেন না!
২০ বছর আগে এক সকালে যোধপুরের কাছে একটি গ্রামে এই বিশনোইরাই হঠাৎ চমকে উঠেছিলেন গুলির শব্দে। বেরিয়ে এসে তারা দেখেন, দুটি কৃষ্ণসার হরিণ লুটিয়ে পড়ে আছে আর তীরবেগে পালিয়ে যাচ্ছে একটি জিপসি। বাইক নিয়ে সেটিকে ধাওয়া করেও জিপসিটিকে ধরতে পারেননি বিশনোই যুবকরা, কিন্তু তারা ঠিকই বুঝেছিলেন গত কদিন ধরে গ্রামের কাছে যে হিন্দি ছবির শ্যুটিং চলছে জিপসিটি সেই টিমেরই।
সেই ছবিটির নাম ছিল ‘হাম সাথ সাথ হ্যায়’। জিপসিটি চালাচ্ছিলেন ছবির নায়ক সালমান খান, বন্দুকও ছিল তার হাতেই। তখন তিনি বত্রিশ বছরের যুবক, অ্যাংগ্রি ইয়ংম্যান। গাড়িতে তার সঙ্গে ছিলেন সাইফ আলি খান, সোনালি বেন্দ্রে, টাবু, নীলমের মতো ওই ছবির অন্য অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। প্রমাণের অভাবে বাকিরা খালাস পেয়ে গেলেও আইন কিন্তু এদিন ৫২ বছর বয়সে এসে ঠিকই সালমানের নাগাল পেয়ে গেল!
‘এই কুড়ি বছর একটাদিনও আমরা কিন্তু বসে থাকিনি। ঘটনার সাক্ষীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে কেস সাজিয়েছি, এমনকি তাদের পরিবারের দেখাশুনা পর্যন্ত করেছি। বিশনোই সমাজ এটাকে একটা মর্যাদার লড়াই হিসেবে দেখেছিল, আর অভিযুক্ত যতই প্রভাবশালী হোক না কেন আমরা ঠিকই জানতাম একদিন না একদিন আদালতে আমাদের কথাই প্রমাণিত হবে’, বাংলা ট্রিবিউনকে এদিন সন্ধ্যায় বলছিলেন মামলাকারীদের পক্ষের আইনজীবী মহীপাল বিশনোই।
তিনি ও তার আইনজীবীরা এদিন যুদ্ধজয়ের হাসি হাসতে পারছেন। কারণ, রাজস্থানসহ সারাদুনিয়ায় ছড়িয়ে থাকা বিশনোই সমাজ এই মামলা লড়তে টাকা যুগিয়েছে। ডোনেশন এসেছে সুদূর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া থেকেও।
যোধপুরের বিশনোই সমাজের অন্যতম প্রধান মুরুব্বি রনবীর বিশনোই এই প্রতিবেদককে বলছিলেন, ‘আমাদের ইতিহাসই এরকম। গাছ বা প্রাণীদের বাঁচাতে একজন বিশনোই জীবন পর্যন্ত দিতে পারে। প্রায় ৩০০ বছর আগে খেজরি গাছের জঙ্গল বাঁচাতে আমাদের নারীরা যোধপুরের রাজার বাহিনীর হাতে প্রাণও দিয়েছিলেন।’
জনশ্রুতি আছে, ১৭৩০ সাল নাগাদ যোধপুরের মহারাজা খেজরির বন সাবাড় করে সেখানে নিজের জন্য একটি প্রাসাদ বানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এই খেজরি গাছকে বিশনোইরা অত্যন্ত পবিত্র বলে মানেন। তাই অমৃতা দেবী নামে এক বিশনোই নারী ও তার তিন কন্যা সেই গাছ জড়িয়ে ধরে বাধা দেন, বলেন তাদের না মেরে সেই গাছ কাটা যাবে না। ফলে রাজার সেনারা তাদের মারতে বাধ্য হয় এবং একইভাবে আরও শত শত বিশনোই নারী-পুরুষ খেজরির বন বাঁচাতে প্রাণ দেন।
প্রাণ ও প্রকৃতি রক্ষার সেই রক্ত আজও বিশনোইদের মধ্যে বহমান। সে কারণেই তারা প্রাণ দিয়ে ভালবাসেন তাদের এলাকার গাছপালা, এবং বিশেষ করে কৃষ্ণসার হরিণ বা চিনকারাকে (যা এক ধরনের অ্যান্টিলোপ), যেগুলোর সংখ্যা কমে আসছে।
বিশনোইদের সেই পশুপ্রেম যে কতটা খাঁটি, যোধপুর জেলের দুই নম্বর ব্যারাকে ১০৬ নম্বর কয়েদির পোশাক পরা সালমান খান এদিন তা বুঝলেন বিরাট চড়া মূল্য দিয়ে!