ফাইজুস সালেহীন: রাজনৈতিক শুদ্ধিকরণ এখন সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি। জাতির পিতার সাহসী কন্যা শেখ হাসিনা; তিনি শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছেন। রাজনীতির দূষিতপানি সবটুকু বিশুদ্ধ হওয়ার আগেই যেন থেমে না যায় এই অভিযান। মনে রাখা বাঞ্ছনীয় যে, একটি জলাশয়ের পানি কখনই আংশিক বিশুদ্ধ করা যায় না। গণতন্ত্রের বিচ্যুতি থাকলে এই বেলায় সংশোধন করে নিতে হবে তা-ও।
ভিন্নমত প্রকাশের অপরাধে বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এই নিরপরাধ নিরীহ ছেলেটির জীবন কারা, কিভাবে হরণ করেছে, তা আজ আর কারো অজানা নেই। নতুন করে বিবরণ দেওয়া নিরর্থক। পাষণ্ড হন্তারকদের রাজনৈতিক পরিচয়ও আর অপ্রকাশিত নেই। আবরার হত্যার প্রতিবাদে বেদনা-বিক্ষোভে উত্তাল বুয়েট ক্যাম্পাস। শিক্ষার্থীরা বিচার চান। তারা বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ্য করার দাবি জানান এবং সেই দাবিটি কর্তৃপক্ষ মেনেও নিয়েছেন। চিহ্নিত খুনীদের মধ্যে কমপক্ষে আঠারোজন গ্রেপ্তার হয়েছে। তাদের কেউ কেউ স্বীকরোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে। ছাত্রলীগ অভিযুক্তদের সংগঠন থেকে বহিস্কার করেছে। ছাত্রলীগও এই খুনীদের শাস্তি দাবি করে চলেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও এই খুনের বিপক্ষে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই অবস্থান নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে।
এখ ন পর্যন্ত পুলিশ প্রশাসন যেভাবে কাজ করে যাচ্ছে, তাতে এমনটি বিশ্বাস করাই সমীচিন যে আবরারের খুনীদের শাস্তি হবে নিশ্চিত। রাষ্ট্র এদের ছেড়ে কথা বলবে না। পথভ্রষ্ট ছেলেদের পাশে বাস্তবিকপক্ষেই আজ আর কেউ নেই। এমন কি এদের কারো কারো পিতামাতাও আবরার হত্যার ন্যায়বিচার চান। পত্রিকায় পড়লাম, খুনীদের কোনো একজনের পিতার প্রশ্ন, তার মেধাবি সন্তান কেমন করে খুনী হয়ে গেলো! সত্যিই এ এক রূঢ়-কঠিন জিজ্ঞাসা। এই জিজ্ঞাসার জবাব কে দেবেন। বুয়েটে, মেডিক্যালে এমন কি যে কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব ছেলেমেয়ে চান্স পান, তুলনামূলকভাবে তারা অনেক মেধাবি; বইপোকা। এরা বখে যাওয়া নয়। লেখাপড়া নিয়েই এরা ব্যস্ত। চিন্তা-ভাবনায় এরা সুশৃঙ্খল এবং নিয়মতান্ত্রিক। এমনটিই সাধারণ লোকবিশ্বাস। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে এরা কেমন করে নষ্ট হয়ে যায়! কেমন করে বদলে যায় এদের জীবনদৃষ্টি! জীবনের কোন অপদেবতার হাতছানি এদের কারো কারো মাথা ঘুরিয়ে দেয়? সেই অপদেবতার ঠিকানা আমরা খুঁজে পাবো কেমন করে?
এই প্রশ্নের জবাবে খুব সাবধানে, ভয়ে ভয়ে কোনো কোনো বিবেকবান মিনমিন করে হয় তো বলবেন, সেই অপদেবতার নাম অপরাজনীতি, রাজনৈতিক অনাচার। তথাকথিত সুশীলের ভাষায় এর নাম রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি। যারা এসব বলেন, তারা সোচ্চারকণ্ঠ হতে পারেন না। তারা ভয় পান। ভয়ের সাথে তাদের ও আমাদের নিত্য বসবাস । এই ভয়কে আমরা জয় করবো কেমন করে? দেশের মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে কেউ তো বিদ্রোহী নজরুলের মতো বলেন না, মা ভৈ, মা ভৈ! ওরে ভয় নেই, সত্য বল! ওরে সত্য বল! অপরাজনীতি কিংবা রাজনৈতিক অনাচারের কাপতান যারা, তাদের বেশিরভাগই স্ববিরোধিতার ঘোলাজলে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। তারা অন্যের দোষ দেখেন, নিজেরটা দেখেন না। যা বলেন, প্রায়শ তা করেন না। দশটা মিথ্যাকে সত্য বানানোর জন্যে তারা একটি সত্য বলেন। দশটা অনাচার ঢেকে দেয়ার জন্যে একটি সদাচরণ করেন। তারা সমালোচনা সহ্য করেন না। সামান্য সমালোচনায় তাদের গায়ে ফোস্কা পড়ে। তারা গণতন্ত্রের চাদর গায়ে দিয়ে গণতন্ত্র হরণ করেন। ভোটের কথা বলে মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেন। পার্লামেন্টে মেজরিটিকে তারা ব্রুট মেজরিটিতে পরিণত করেন। তারা আমি আর আমরা ছাড়া কিছইু বুঝেন না। তারা ফ্রাংকেনস্টাইনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে দানব তৈরি করেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত দানবকে তারা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে পারেন না।
ক্ষমতাসীন কিংবা ক্ষমতার বাইরে থাকা এদেশে সক্রিয় কোনো দল বা গোষ্ঠির এসব কথায় রেগে যাওয়া উচিত নয়। কেননা, এই লেখায় কোনো বিশেষ দলের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করা হচ্ছে না। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সেভেন মার্ডার হয়েছিলো। সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছিলো। সাজা হয়েছিলো। জিয়াউর রহমান সেই সাজাপ্রাপ্ত খুনীদের মুক্তি দিয়েছিলেন। সাজাপ্রাপ্তদের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করা হয়েছিলো। তারপরে ক্যাম্পাসে কত রক্ত ঝরেছে, কতবার রক্তে রঞ্জিত হয়েছে ক্যাম্পাসের সবুজ ঘাস তার ইয়ত্তা নেই। কোনো কোনো ঘটনার বিচার হলেও আসামী ধরা পড়েনি, এমন দৃষ্টান্তের অভাব নেই। আবার অনেক খুনের কোনো কুল কিনারা হয়নি। এই তো চলে আসছে। এ সব কিছুর পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি। আর এই অপসংস্কৃতির একটাই উদ্দেশ্য; গণতন্ত্রকে খাঁচাবন্দী করে রাখা।
এই রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির শুরুর জায়গাটা চিহ্নিত করা কঠিন। সত্য সনাক্ত করতে গেলে, এ দুষবে তাকে, সে দুষবে একে। ফলাফল শুন্য। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘন্টা তো বাঁধতে হবে। রাজনৈতিক শুদ্ধিকরণ এখন সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি। জাতির পিতার সাহসী কন্যা শেখ হাসিনা; তিনি শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছেন। রাজনীতির দুষিতপানি সবটুকু বিশুদ্ধ হওয়ার আগেই যেন থেমে না যায় এই অভিযান। মনে রাখা বাঞ্ছনীয় যে, একটি জলাশয়ের পানি কখনই আংশিক বিশুদ্ধ করা যায় না। গণতন্ত্রের বিচ্যুতি থাকলে এই বেলায় সংশোধন করে নিতে হবে তা-ও।