আন্তর্জাতিক ডেস্ক: সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদের কাছে গত শনিবার ইয়েমেনের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ও সৌদি আরবে গিয়ে লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরির পদত্যাগের ঘোষণার জেরে মধ্যপ্রাচ্যের দুই চির-প্রতিদ্বন্দ্বি সুন্নিপন্থী সৌদি আরব ও শিয়া অধ্যুষিত ইরানের মধ্যে যুদ্ধের শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
প্রাণনাশের আশঙ্কার কথা জানিয়ে ওইদিন পদত্যাগের ঘোষণা দেন লেবাননের প্রধানমন্ত্রী। এজন্য ইরান এবং হিজবুল্লাহকে দায়ী করেন তিনি। তার এই আকস্মিক পদত্যাগের ঘোষণায় লেবাননে রাজনৈতিক সংকট শুরু হয়েছে।
হারিরির পদত্যাগের পর থেকেই ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে যুদ্ধের আশঙ্কা প্রকাশ করে আসছেন কূটনীতিকরা। একই দিনে রিয়াদের প্রধান বিমানবন্দর লক্ষ্য করে ইয়েমেন থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রটি ইরানের তৈরি বলে দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন বিমান বাহিনীর জ্যেষ্ঠ এক কমান্ডার বলেছেন, ক্ষেপণাস্ত্রটিতে ইরানের সাঙ্কেতিক চিহ্ন রয়েছে এবং সেটি ছোড়া হয়েছে ইরান থেকেই।
এদিকে, লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ আল-হারিরিকে আটকে রেখে এবং তাকে জোর করে সৌদি আরব পদত্যাগ করিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। লেবাননের ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন হিজবুল্লাহ প্রধান সাইয়েদ হাসান নাসরুল্লাহ বলেছেন, লেবানন ও তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে সৌদি আরব।
বিবিসির কূটনৈতিক প্রতিবেদক পল অ্যাডামস সৌদি-ইরান যুদ্ধের ভয়াবহতা নিয়ে এক প্রতিবেদনে বলেছেন, এ দুই দেশ যদি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তাহলে তা মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনবে; যা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। লেবাননকে ঘিরে ওই অঞ্চলে প্রক্সি যুদ্ধ শুরু হতে পারে।
‘এটা এক ধরনের ক্ষমতার লড়াই; যা গত ৪০ বছর ধরে চলে আসছে। সৌদি আরবে ইসলামের পবিত্র দুটি স্থাপনা আছে এবং দেশটি সব সময় মনে করে তারা মুসলিম বিশ্বের অবিসংবাদিত নেতা। কিন্তু ১৯৭৯ সালে আয়াতুল্লাহ খোমেনি ও ইরানের ইসলামি বিপ্লবের পর সৌদির এই ভাবনায় ভাঁজ পড়ে। এর পর থেকেই মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছে তেহরান। এই আধিপত্য বিস্তার চেষ্টা চলছে ইরান পূর্বাঞ্চল থেকে শুরু করে পশ্চিমাঞ্চলের লেবাননেও। সৌদি আরব তখন থেকেই ইরানকে নিজ পরিসরের হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে আসছে।’
পল অ্যাডামস বলেছেন, দুই দেশের ইসলাম ধর্মের দুটি অংশের প্রতিনিধিত্ব করছে। সুন্নিপন্থীর নেতৃত্বে আছে সৌদি আরব, শিয়া মতাবলম্বীদের নেতৃত্বে ইরান। ভূরাজনৈতিক চিরবৈরী এই দুই দেশের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ধর্মীয় মতের ছোঁয়াও রয়েছে।
ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধ চলছে; সেখানে একপক্ষকে সমর্থন দিচ্ছে সৌদি আরব; অপরপক্ষে ইরান। সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে সমর্থন দিচ্ছে সৌদি আরব। তার সহায়তায় দেশটিতে সামরিক বাহিনীও পাঠিয়েছে রিয়াদ। দেশটিতে বিদ্রোহী ও সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে অর্থায়ন এবং অস্ত্রও সরবরাহ করছে সৌদি।
ইরাকে সাদ্দাম হুসেইনের পতনের পর ইরানের প্রভাব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্প্রতি ইরাকে প্রভাব বলয় বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়েছে সৌদি আরব। এরপরই লেবানন; যেখানে প্রধানমন্ত্রী হারিরির পদত্যাগের জেরে নতুন করে সঙ্কট তৈরি হয়েছে। দশকের পর দশক ধরে ইরান শিয়া মিলিশিয়া ও রাজনৈতিক দল হিজবুল্লাহকে সহায়তা দিয়ে আসছে। হিজবুল্লাহ লেবানন সরকারের সঙ্গে আছে এবং সিরিয়া, ইয়েমেন ও ইরাকেও লড়ছে। সৌদি আরবের জন্য যা বেশি চিন্তার উদ্রেক ঘটিয়েছে। সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ওয়ান ম্যান আর্মি স্টাইলে দেশ পরিচালনা করছেন। বিভিন্ন সময়ে ইরানের ব্যাপারে কঠোর অবস্থানের জানান দিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে মুসলিম বিশ্বে আধিপত্য বাড়ানোর অভিযোগ আছে।
অনেকেই বলছেন, সৌদির এই যুবরাজের নির্দেশেই লেবাননের প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। সৌদি আরব সাদ হারিরি আকস্মিকভাবে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আমি ইরান এবং তার অনুসারীদের বলতে চাই, তারা আরব বিশ্বের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন ব্যাপারে নাক গলানোর ক্ষমতা হারাচ্ছে। গুজব রয়েছে, ইরানের প্রভাব ও হিজবুল্লাহকে মোকাবেলার চেষ্টা করছে সৌদি আরব। পল অ্যাডামস বলেছেন, যদি তাই হয় তাহলে সেটি হবে বিপজ্জনক এক ভূখণ্ড। আর লেবাননের মতো একটি দেশকে ঘিরে যদি মধ্যপ্রাচ্যের এই প্রক্সিযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে যেখানে প্রচুর সংঘাত দেখা গেছে। তা ইরান এবং সৌদি স্নায়ুযুদ্ধের নতুন একটি ফ্রন্ট চালু করবে; এর ভয়াবহ বিপর্যয়ের মাত্রা মানুষের কল্পনাকে ছাড়িয়ে যাবে।