আন্তর্জাতিক ডেস্ক: সৌদি আরবের রিজ কার্লটন হোটেলের অতিথিরা ৪ নভেম্বর একটি বার্তা পেয়েছিলেন। বার্তাটি দিয়েছিল রিয়াদের এই হোটেল কর্তৃপক্ষ। বলেছিল, ‘সর্বোচ্চ নিরাপত্তার প্রয়োজন আছে, এমন স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অপ্রত্যাশিত বুকিং এসেছে। এ কারণে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসার আগ পর্যন্ত কোনো অতিথিকে আমাদের পক্ষে রাখা সম্ভব হচ্ছে না।’ তখন কি কেউ ভাবতে পেরেছিলেন—এই বার্তা আসলে সৌদি রাজপরিবার ও প্রশাসনে রদবদলের প্রাথমিক ইঙ্গিত?
কারণ, এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু হয়। নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে দেশটির রাজনীতি ও ব্যবসা ক্ষেত্রের বহু রাঘব-বোয়াল গ্রেপ্তার হন। তাদের মধ্যে আছেন ১১ প্রিন্স, বর্তমান ও সাবেক মন্ত্রী, ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। মূলত রাজধানী রিয়াদ ও বন্দরনগরী জেদ্দায় অভিযানটি চালানো হয়।
তাদের অনেককেই সভার জন্য ডেকে নিয়ে সভাস্থলেই আটক রাখা হয়। অন্যদের নিজ বাড়ি থেকে গ্রেপ্তারের পর নিয়ে আসা হয় রিয়াদের রিজ কার্লটন হোটেলে, যা একটি অস্থায়ী কারাগারে পরিণত হয়েছে। পরিবারের সঙ্গে একবার মাত্র কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয় আটক ব্যক্তিদের। সংশ্লিষ্ট এক ব্যক্তি বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
ওই ব্যক্তি রয়টার্সকে বলেন, ‘তাদের কড়া নিরাপত্তায় রাখা হয়েছে। তারা কোনো ফোনকল রিসিভ করতে পারছেন না। কারও পক্ষে সেখানে ঢোকা বা বের হওয়া সম্ভব নয়। এটা নিশ্চিত যে এর জন্য বড় ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল।’
শুদ্ধি অভিযানের আদেশটি এসেছে সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের কাছ থেকে। সৌদি আরবকে আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করা এ যুবরাজ এখন দেশটিকে নিজের লক্ষ্য অর্জনের পথে চালিত করছেন। নিজের ক্ষমতাকে একচ্ছত্র করে এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য তিনি চড়াও হয়েছেন সৌদি অভিজাতদের ওপর। তাদের বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণ ও বিভিন্ন ব্যবসা প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে দেখানোর মতো বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল উৎপাদনকারী দেশটির রাজনীতি বর্তমানে সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই শুদ্ধি অভিযানের সাফল্যের ওপরই নির্ভর করছে যুবরাজ মোহাম্মদের দেশ শাসনের সক্ষমতার বিষয়টি। তিনি মনে করেন, গুণগত পরিবর্তন আনা না গেলে সৌদি অর্থনীতি সমস্যার চোরাবালিতে নিমজ্জিত হবে, যা উসকে দিতে পারে অস্থিরতাকে। আর এটি রাজপরিবারের সঙ্গে সঙ্গে ইরানের সঙ্গে চলমান আঞ্চলিক লড়াইয়ে সৌদি আরবকেও দুর্বল করবে।
রাজপরিবার ঘনিষ্ঠ একজন রয়টার্সকে জানিয়েছেন, পরবর্তী বাদশাহ হিসেবে যুবরাজকে তাঁর অনেক জ্ঞাতিই মেনে নিতে পারেননি। আর এটি জানার পরই যুবরাজ এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বিরোধীদের প্রতি বিন্দুমাত্র সমর্থন রয়েছে এমন যে কারও ওপর নজরদারির আদেশ ছিল। দুর্নীতিবিরোধী এ অভিযানের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে রাজপরিবার। আর বাকি যা কিছু, তার পুরোটাই এটিকে আড়াল করতে।
শুদ্ধি অভিযানের কারণ হিসেবে বরাবরের মতোই ‘জনস্বার্থের’ কথাই বলেছেন সৌদি বাদশাহ সালমান। এ অভিযানের আগে বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে গোয়েন্দা বিভাগ। আর এসব তথ্যে ভিত্তিতেই পরে গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানিয়েছে একটি সূত্র। তবে শুরু থেকেই এ অভিযানকে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের অপসারণের কৌশল হিসেবে বর্ণনা করে আসছেন বিশ্লেষকেরা। যদিও রাজপরিবার এমন কোনো উদ্দেশ্যের কথা খারিজ করে দিয়েছে। আর রাজকীয় আদালত বিষয়টি সম্পর্কে এখনো নিশ্চুপ।
রিজ হোটেলে গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে আছেন ক্ষমতাধর ন্যাশনাল গার্ডের সাবেক প্রধান যুবরাজ মিতেব বিন আবদুল্লাহ। যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে বৈঠকের কথা বলে নিজের বাগানবাড়ি থেকে তাঁকে রিজ হোটেলে ডেকে নেওয়া হয়। আর তারপর সেখানেই তাঁকে বন্দী করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে এ ছাড়াও রয়েছেন আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান কিংডম হোল্ডিংয়ের চেয়ারম্যান যুবরাজ আলওয়ালিদ বিন তালাল এবং রিয়াদের সাবেক গভর্নর ও প্রয়াত বাদশাহ আবদুল্লাহর ছেলে তুর্কি বিন আবদুল্লাহ।
রাজপরিবারের ঘনিষ্ঠদের মতে, সাম্প্রতিক বিভিন্ন বৈঠকের সূত্র ধরেই অস্থিরতার সূচনা। যুবরাজ মিতেবের মতো ক্ষমতাবান বেশ কয়েকজন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের উত্থানে অসন্তুষ্ট ছিলেন। সে সময়ই বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে সৌদি আরবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত হওয়ার কথা বলেছিলেন তিনি, যেখানে কোনো উচ্চপদস্থকেও ছাড় দেওয়া হবে না। আর এ কাজের জন্য বাদশাহ সালমান দুর্নীতিবিরোধী কমিটি গঠন করেন। এর ঘোষণা আসে ৪ নভেম্বর। এ কমিটির দায়িত্ব দেওয়া হয় যুবরাজ মোহাম্মদের ওপর, যা গত তিন বছরে তাঁর পাওয়া অসংখ্য ক্ষমতার তালিকায় ছিল এক নতুন সংযোজন।
৯ নভেম্বর দেশটির অ্যাটর্নি জেনারেল জানান, দুর্নীতির তদন্তে মোট ২০৮ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে অন্তত ১০০ বিলিয়ন ডলারের দুর্নীতির হদিস পাওয়া গেছে। এসব দুর্নীতির প্রমাণ তিন বছর ধরে সংগ্রহ করা হয়েছে।
যুবরাজ তুর্কি বিন ফয়সালের সাবেক উপদেষ্টা জামাল খাশোগগি বলেন, ‘যুবরাজ দুর্নীতির মতো একটি জনপ্রিয় বিষয়কে বেছে নিয়েছেন, যা দিয়ে তাদের সবার কাছে পৌঁছানো সম্ভব। জীবনে প্রথমবারের মতো আমরা দুর্নীতির জন্য যুবরাজদের বিচার হতে দেখছি। কিন্তু যুবরাজ মোহাম্মদের এ অভিযান সর্বব্যাপী নয়। তিনি নিঃসন্দেহে দেশপ্রেমী একজন জাতীয়তাবাদী। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তিনি একাই শাসন করতে চাইছেন।’
যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে বর্তমানে সৌদি আরবের ডি ফ্যাক্টো শাসক বলা যায়, যার উত্থান ২০১৫ সালে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হওয়ার মধ্য দিয়ে। ওই সময় বর্তমান বাদশাহ মসনদে বসেছেন। গত জুনে মোহাম্মদ বিন নায়েফকে সরিয়ে ক্রাউন প্রিন্স (পরবর্তী শাসক) ঘোষণা করা হয় যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে। রাজপরিবারও বিষয়টি মেনে নেয়। আর গত সেপ্টেম্বরের মধ্যেই যুবরাজ বিরোধী ধর্মীয় নেতা ও বুদ্ধিজীবীদের কারাগারে পাঠানো শুরু হয়।
সাম্প্রতিক গ্রেপ্তার অভিযান ১৯৩০ সালে বর্তমান সৌদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর বাদশাহ আবদুল আজিজ প্রতিষ্ঠিত ধ্যান-ধারণাকে পুনর্মূল্যায়নের পথে সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ। আবদুল আজিজ সে সময় ওহাবি নেতাদের সঙ্গে রাজপরিবারের একটি সমন্বয় করেছিলেন। আরামদায়ক জীবন ও তেল সম্পদের অংশীদারত্ব দেওয়ার বিনিময়ে রাজপরিবার এবং কঠোর ধর্মীয় ও সামাজিক বিধিনিষেধের প্রতি সৌদিদের পূর্ণ আনুগত্য চাওয়া হয়েছিল তখন। ১৯৫৩ সালে ইবনে সৌদ নামে পরিচিত আবদুল আজিজের মৃত্যুর পর থেকে সৌদি আরব বাদশাহি শাসনের অধীনে। আর তার ছায়াতলে রয়েছেন যুবরাজের দল, যাদের কারও পক্ষে অন্যদের এড়িয়ে কিছু করা সম্ভব নয়। অধিকাংশ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ঐক্যের ভিত্তিতে। এটি সৌদি রাজতন্ত্রে স্থিতি আনলেও সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। এ অবস্থাতেই নতুন ইবনে সৌদ হিসেবে হাজির হয়েছেন যুবরাজ মোহাম্মদ, যিনি বিদ্যমান সব ব্যবস্থা টেনে ছিঁড়ে ফেলছেন। ঐকমত্যের ব্যবস্থা প্রতিস্থাপন করছেন একনায়কতন্ত্র দ্বারা।
গত কয়েক দশকে ভাই, ছেলে ও ভাতিজাদের সম্মিলিত পরামর্শে রাজ্য পরিচালনা দস্তুর মনে করেছেন সৌদি বাদশাহরা। কিন্তু যুবরাজ মোহাম্মদ উচ্চ পদে নিজের কোনো ভাই বা আত্মীয়কেই স্থান দেননি। তিনি তাঁর উপদেষ্টা দলের ওপরই বেশি আস্থাবান, যেখানে রয়েছেন ব্রিটিশ ও মার্কিন প্রশিক্ষিত সৌদিরা। কাগজে কলমে সব ক্ষমতা এখনো বাদশাহ সালমানের হলেও সামরিক, নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক পররাষ্ট্র ও সামাজিক বিষয়গুলোর দেখভাল করেন যুবরাজ মোহাম্মদই। এমনকি মাঝে কয়েক মাস ধরে এমন জল্পনাও ছিল যে ৮২ বছর বয়সী বাদশাহ শিগগিরই ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন যুবরাজের কাছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি।
৩২ বছর বয়সী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান নতুন সামাজিক চুক্তির কথা বলছেন, যেখানে আগের মতো স্থবির আমলাতন্ত্র থাকবে না। তেলের বাজারে যাই হোক না কেন, যেখানে থাকবে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সম্ভাবনাময় বেগবান অর্থনীতি। তিনি ৫০০ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে একটি প্রযুক্তিনির্ভর শহর স্থাপনের পরিকল্পনা কথা বলছেন, যেখানে নারী-পুরুষ অবাধে চলতে পারবে। সৌদি নারীদের গাড়ি চালনার অনুমোদনের প্রতিশ্রুতিও রয়েছে তাঁর। তেলভিত্তিক অর্থনীতির একটি দেশ থেকে সৌদি আরবকে একটি বহুমুখী অর্থনীতির দেশে রূপান্তরের পরিকল্পনাও তিনি তুলে ধরেছেন। কিন্তু তাঁর এসব লক্ষ্য অর্জনের কোনো নিশ্চয়তা নেই।
বিশ্লেষকদের মতে, বিনিয়োগকারীরা আইনের শাসন ও নিরাপত্তা চায়। কিন্তু বিরুদ্ধ মতের প্রতি যুবরাজের কঠোর আচরণ অনেক বিনিয়োগকারীকেই শঙ্কিত করছে। আর বিনিয়োগকারীদের সহায়তা ছাড়া তাঁর একার পক্ষে সৌদি তরুণদের আশা পূরণ সম্ভব নয়। সঙ্গে রয়েছে ইয়েমেন যুদ্ধ, কাতারের সঙ্গে কূটনৈতিক সংকট ও ইরানের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান বিরোধ। এসব কিছু উতরে বিনিয়োগ আকর্ষণ ও কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন সাধন করতে যুবরাজের এখন সম্ভবত মার্কিন প্রশাসনের সহায়তাই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। এখন পর্যন্ত তা আছেও। কারণ, সর্বশেষ গ্রেপ্তার অভিযানের পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প টুইটার পোস্টের মাধ্যমে তাঁর সমর্থন জানিয়েছেন।