লেখা পড়ার জন্য প্রতিটি দিনই শিক্ষার্থী দিবস। শিক্ষার্থী বললে আমরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকেই বুঝে থাকি। যারা বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জ্ঞানার্জনের জন্য লেখাপড়া করে তাদেরকেই বুঝি। বিশেষ করে প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জনকেই বুঝে থাকি। কিন্তু উচ্চ শিক্ষার বিভিন্ন স্তরকে সাধারণত: শিক্ষার্থীর আওতামুক্ত বলে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দের কথা যদি বিবেচনা করা হয় তা হলে অন্য অর্থ প্রকাশ পায়। বিবেকানন্দ বলেছেন, “বিশ্ব জুড়ে পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র”। কতো সহজ অথচ গভীর কথা। আমরা বি এড বা এম এড প্রশিক্ষণ গ্রহণে গেলেও প্রশিক্ষক মহোদয়গণ বলে দেন “একজন শিক্ষক সারাজীবনের জন্য ছাত্র”। কিন্তু প্রশিক্ষণের পরে সেটা খুব একটা আমলে আনি না। শিক্ষার্থী শব্দটি ব্যাপক। এটাও আমলে আনি না। তা’ছাড়া ব্যাংকার, ডাক্তার, উকিল, ব্যবসায়ী সহ সকল পেশাজীবিই পড়ালেখা করেন। নিজেকে ছাত্র মনে করেন না। যারা রাজনীতির সাথে জড়িত বা কোনো ধর্মীয় প্রচার ও ধর্মপালন করেন তারাও পড়াশুনা করেন। শিক্ষার্থীত্ব কে কতোটুকু মনে রাখেন তা গবেষণার বিষয়। শিক্ষক হলে তো কথাই নেই। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীত্ব মনে করার কারণ থাকার দরকারও পড়ে না। লেখাপড়া শেষ করে তবেই না শিক্ষক। শিক্ষক তো পড়াবেন। তাকে আবার পড়তে হবে এটা কী মানানসই কাজ। কিন্তু শিক্ষককে সব থেকে বেশি পড়ার কথা। পেশাদরিত্বের শপথ থাকলে অবশ্যই পড়তে হবে। যখন পড়বে তখন ঐ শিক্ষক অবশ্যই একজন উঁচুমানের শিক্ষার্থী বলে বিবেচিত হবেন।
১৭ নভেম্বর বিশ্ব শিক্ষার্থী বিদস। ১৯৩৯ সালে জার্মানীর ফ্যসীবাদী নাতশী (Nazi) বাহিনী জোর করে চেকোশ্লোভাকিয়া দখল করে। এ অন্যায়ের প্রতিবাদ করে চেকোশ্লোভাকিয়ার প্রাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তারা এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সত্য ন্যায়ের প্রতীক নির্মোহ ছাত্রসমাজ তাদের জাতীয় স্বার্থে এ কাজে উদ্বুদ্ধ হয়। জাতীয় স্বার্থকে রক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা মানবতার অপমান হতে মানুষকে রক্ষা করার পথে এগিয়ে চলার শপথ নেয়। ফ্যাসীবাদী তথাকথিত নাতশী স্যোসাল পার্টি ঐ ছাত্রদের গুলি করে। এতে নয় জনের প্রাণ হানি ঘটে। বারশ ছাত্রকে তারা বন্দী শিবিরে নিয়ে অকথ্য নির্যাতন করে। এতোকিছুর পরও ছাত্রসমাজ এগিয়ে চলতে থাকে। তখন ঐ ফ্যাসীবাদী নাতশী বাহিনী গ্রাগ বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সকল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়। তাদের ভাবনায় আসে লেখাপড়া বন্ধ করে দিলে কেউ আর আমাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস ও সুযোগ পাবে না মানুষকে তারা শিক্ষাবিহিন জীবনে পরিণত করে দেবে। আমাদের দেশেও ১৯৭১ সালে তদানীন্তন পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী স্বাধীনতা সূর্য ওঠার সময়ে অনেক বুদ্ধিজীবি শিক্ষিত মানুষকে হত্যা করেছিলো। জাতিকে বুদ্ধিহীন-মেধাহীন করার সে হত্যা ষড়যন্ত্র বীর বাঙ্গালীরা রুখে দিয়েছিলো। শহীদ বুদ্ধিজীবিদের স্মরণে প্রতিবছর ১৪ নভেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবি দিবস পালন করা হয়। বিশ্বে বিভিন্ন সময়ে এমন বর্বরোচিত ঘটনা ঘটায় পৈচাশিক পেশি শক্তি। কিন্তু যুগে যুগে ঐ সব অপশক্তি ধ্বংস করেছে মানব প্রেমিক, সত্যের পথিক বিভিন্ন শ্রেণি গোত্রের মানুষ। এমনই একটি বিশ্ব ইতিহাস সৃষ্টিকারি কাজ করেছে প্রাগের ছাত্রসমাজ। তাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য বিশ্বব্যাপী সুডেন্টস, দিবসটি উদযাপন করা হয়। এটা ছাত্রদের জন্য গৌরবের। অন্য দিকে তাদের বোধ জাগানোর শপথ গ্রহণের বয়ান করার দিন। কোনো অন্যাযের কাছে মাথা নত না করা সত্যকে সত্য বলে শুধু জানা-মানা নয় সত্যকে প্রতিষ্ঠা করা ছাত্রদের প্রধান কাজ। সমাজ হতে দেশ হতে সকল অন্যায় অসত্য দুর্নীতি দূর করার সংকল্প গ্রহণ ও তা সর্ব ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করে একটা সুন্দর সমাজ, রাষ্ট্র তথা বাসযোগ্য পৃথিবী গড়া ছাত্রসমাজের দ্বারাই সম্ভব। আজকের ছাত্র আগামীর সোনালী মানুষ। সব দায়িত্ব নেয়ার প্রস্তুতির এটাই উপযুক্ত সময়। অসম্ভব সম্ভাবনার যে মেধা ছাত্রদের মাঝে আছে তা কাজে লাগানোর প্রশিক্ষণ গ্রহণের সময়। ব্যর্থ হবার কোনো সুযোগ ছাত্রসমাজের নেই। তারা ভবিষ্যতের কর্ণধার। এ দিনটি হচ্ছে ছাত্রদের অধিকার আদায়ের দিন। এ দিনটি ছাত্রদের সম্মান জানানোর দিন। অধিকার আদায় এবং সম্মান অর্জনের পাশাপাশি এ দিনটি তাদের আত্মোপলদ্ধিরও দিন।
আমাদের ছাত্রসমাজের অনেক গৌরবগাঁথা আছে। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন, মহান ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান মহান স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং আরো অনেক সাফল্য। কোনো অপশক্তির ছায়া আমাদের ছাত্রসমাজকে সত্য প্রতিষ্ঠায় অধিকার আদায়ের বিচ্যুত করতে পারেনি। ছাত্রদের কাছেই জাতির আকাংখ্যা পূরণের একটি জায়গা তৈরী হয়েছে। জাতির চরম দুর্দিন দু:সমযে ছাত্ররা জীবনবাজি রেখে জাতির সংকট হতে জাতিকে মুক্ত করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজের কিছু কর্মকান্ড প্রশ্নবিদ্ধ হলেও জাতি অনেক আশাবাদি। এ সংকট কাটিয়ে ছাত্র সমাজ তাদের জ্ঞানের আলোতে জাতিকে আলোকিত করবে। জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার দ্বারা সব বাধা পেরিয়ে যাবে। শত বাধা উত্তোরণের সে অমিত সাহস ছাত্রসমাজের কাছেই জাতি প্রত্যাশা করে। ছাত্রসমাজ শুধু জিপিএ পাঁচ (৫) এর পেছনে না দৌড়িয়ে জ্ঞানের অনুসন্ধান করে প্রকৃত মানুষ হবে এটাই কামনা করি। শিক্ষা প্রসঙ্গে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর বাণী হলো, “দোলনা হতে কবর পর্যন্ত শিক্ষা”।
লেখক: শেখ আব্দুস সালাম, প্রধান শিক্ষক
শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়, টঙ্গী, গাজীপুর
০১৮৫৬-৪৭০০৫০
sshs.tongi@yahoo.com